Tuesday , April 16 2024
You are here: Home / অন্যান্য / মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান
মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান

মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান

বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগতে ভরা আমাদের এই পৃথিবী। বিচিত্র স্বভাবের হাজারও প্রাণী ছড়িয়ে রয়েছে এখানে-সেখানে। প্রকৃতির খেয়ালেই নিকটাত্মীয়ের চেয়ে আলাদা অনেক প্রাণী। আকৃতি আর আচার-আচরণে নিজস্ব এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিচরণ করছে তারা।

বাংলাদেশও বিচিত্র আর নানা রঙ-বেরঙের প্রাণীতে ভরপুর। সুন্দর কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে এখনও টিকে থাকার যুদ্ধে লড়াইরত এমনই অদ্ভুত এক প্রাণীর নাম চশমাপরা হনুমান। তাদের ‘গেছো ভদ্রলোক’ বলেও বিবেচনা করা হয়। দিনদিন অন্য সব প্রাণীর মতো বিপন্ন হচ্ছে সুন্দর এই প্রাণী। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ‘বিপন্ন’ আর বাংলাদেশে ‘মহাবিপন্ন’ চশমাপরা হনুমান।

মহাবিপন্ন মানে, হারিয়ে যাওয়ার শেষ ধাপে আছে প্রাণীটি। তবে আসার কথা হচ্ছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া, আদমপুর, পাথারিয়া ও সাগরনালবনসহ হবিগঞ্জের দুটি বনে প্রায় ৪০০ চশমাপরা হনুমানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যারা প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে এখনও টিকে আছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একদল গবেষক গত দুই বছর গবেষণা চালানোর পর এমন তথ্য দেন।

PHAYRE

একটি চশমাপরা হনুমান পরিবার

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহারের তত্ত্বাবধানে যুক্তরাজ্যের রাফর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক অনুদানে একদল গবেষক মৌলভীবাজারের লাউয়াছাড়া, আদমপুর, পাথারিয়া এবং হবিগঞ্জের সাতছড়ি ও রেমা-কালেঙ্গা বনে দুই বছরব্যাপী (২০১৮- ২০১৯) বিপন্ন এই প্রাণীর সংখ্যা জরিপ করেন। মহাবিপন্ন এই প্রাণীকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রথম ধাপ হিসেবে তাদের বর্তমান অবস্থা এবং তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়।

গবেষক দলের প্রধান তানভীর আহমেদ জানান, গবেষণায় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পাঁচটি বনে ৩৬টি ভিন্ন দলে মোট ৩৭৬টি চশমাপরা হনুমান সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল বনেও চশমাপরা হনুমান পাওয়া গেছে। যদিও অনুদানের সীমাবদ্ধতার কারণে এই বনে হনুমানের সংখ্যা জরিপ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে ধারণা করা হচ্ছে যে, এই বনে তিন থেকে চারটি দলে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫টি চশমাপরা হনুমান থাকতে পারে। সুতরাং কেবল সিলেট বিভাগেই প্রায় ৪০০ চশমাপরা হনুমানের বসবাস।

গবেষণা চলাকালে সবচেয়ে বেশি চশমাপরা হনুমানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছাড়া জাতীয় উদ্যানে। সেখানে ১০টি দলে মোট ১২৬টি চশমাপরা হনুমানের দেখা মেলে। এরপরের অবস্থানে রয়েছে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মৌলভীবাজারের বড়লেখার উপজেলার পাথারিয়া সংরক্ষিত বন। আশার কথা হলো, এই গবেষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা আগের ধারণার থেকে ভালো। যদিও বিভিন্ন কারণে এ সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।

PHAYRE

গবেষণায় দিকনির্দেশনা ও বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ক্রেইগ স্ট্যানফোর্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবির বিন মুজাফফর।

গবেষকদলের অন্যরা হচ্ছেন- সহযোগী গবেষক মো. সাবিত হাসান, ফিল্ড ম্যানেজার শিমুল নাথ, গবেষণা সহকারী সজীব বিশ্বাস। এই দলের বাইরেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।

গবেষকদল জানান, যুক্তরাজ্যের ওয়েলস ইউনিভার্সিটির গবেষক এস পি গিটিন্স ও বাংলাদেশ বনবিভাগের বন্যপ্রাণীবিদ এ ডব্লিউ আকন্দের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩০০টি। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. ফরিদ আহসান তার এমফিল গবেষণায় বাংলাদেশে এই হনুমানের সংখ্যা উল্লেখ করেছিলেন ১০৫০টি। কিন্তু ২০০৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ‘STATUS OF SOUTH ASIAN PRIMATES: CONSERVATION ASSESSMENT AND MANAGEMENT PLAN WORKSHOP’ রিপোর্টে বলা হয়, সারাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা ১০০টিরও কম। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হনুমানের সংখ্যা ৫০টির কম। অর্থাৎ তিন প্রজন্মে (প্রতি প্রজন্ম ১০-১২ বছর) চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা পৃথিবীব্যাপী ৫০ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে হ্রাস পেয়েছে ৮০ শতাংশ। যদিও ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালের হিসাবের সঙ্গে বর্তমানের হিসাব মেলালে ২০০৩ সালে উল্লিখিত বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যাকে ‘উল্লেখযোগ্যভাবে কম (SIGNIFICANTLY UNDERESTIMATED)’ মনে করছেন গবেষকরা।

PHAYRE

হনুমানের ফল খাওয়া

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট- আইইউসিএন কর্তৃক ২০১৫ সালে প্রকাশিত লাল তালিকা বইতে বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের বর্তমান সংখ্যা উল্লেখ না করলেও সেখানে বলা হয়, এই প্রজাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ২০০৮ সাল থেকেই চশমাপরা হনুমান পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে আইইউসিএন। এ কারণে প্রজাতিকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ওঠে। অন্যথায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে প্রজাতিটি। যদিও এই গবেষণার আগে প্রাণিটি সংরক্ষণে বিশেষ কোনো গবেষণা বা উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

দেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা কত— এ বিষয়ে আগে কখনওই বিজ্ঞানভিত্তিক কিংবা মাঠপর্যায়ে জরিপ করা হয়নি। এ কারণে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বাংলাদেশের কোন বনে বর্তমানে কত সংখ্যক চশমাপরা হনুমান টিকে আছে সে তথ্য সঠিকভাবে নিরূপণের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়। সিলেট বিভাগে (মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ) প্রাণিটির অবস্থান ভালো হওয়ায় এখানেই প্রথম জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহার বলেন, চশমাপরা হনুমান কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ কমে যাওয়া। বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা এবং গাছ কেটে বনকে ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করাই চশমাপরা হনুমানসহ সকল বৃক্ষচারী প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ।

PHAYRE

চশমাপরা হনুমান কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে গবেষক তানভীর আহমেদ জানান, বিষয়টি মানবকেন্দ্রিক ও বেশ জটিল। বনভূমির পরিমাণ তো কমছেই, সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও প্রাকৃতিক ফলদ বৃক্ষ কেটে কাঠের গাছ লাগানো হয়েছে। ফলে ওই এলাকার প্রাণিদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে এবং তারা বনের বাইরে খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসছে। অবৈধভাবে সংরক্ষিত বন থেকে নিয়মিত বাঁশ ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মৌলভীবাজারের আদমপুর, পাথারিয়া ও সাগরনাল বনে অবৈধ শিকার ও বাণিজ্যের কারণে এই হনুমানের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।

‘এসব সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বনের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন নেয়া। আমাদের প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লাওয়াছড়া, সাতছড়ি ও পাথারিয়া বনে অন্যান্য প্রাণীর পাশাপাশি মোট আটটি চশমাপরা হনুমান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। এর মধ্যে পাঁচটি সাথে সাথেই মারা যায় এবং বাকি তিনটি মারাত্মকভাবে আহত হয়। এখনই এদের রক্ষায় গুরুত্ব না দিলে একসময় এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে’- শঙ্কা প্রকাশ করেন তানভীর আহমেদ।

চমশমাপরা হনুমান প্রকৃতির জন্য খুবই উপকারী— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তাদের খাদ্যের ৪৭ শতাংশ হলো বিভিন্ন গাছের পাতা। ১৪ শতাংশ হলো ফল ও বীজ। খাদ্যগ্রহণ শেষে ফলের বীজ বনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এরা। যা মূলত বনকে নতুন জীবন দান করে। তাই এ হনুমান বিপন্ন হলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনায়নের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে।

PHAYRE'S-LANGUR

লাফিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাচ্ছে চশমাপরা হনুমান

বাংলাদেশে মোট পাঁচ প্রজাতির বানর, তিন প্রজাতির হনুমান, এক প্রজাতির করে নরবানর (উল্লুক) ও লজ্জাবতী বানর পাওয়া যায়। হনুমানগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্দর প্রাণী হচ্ছে চশমাপরা হনুমান। এদের চোখের চারপাশে গোলাকার বৃত্তের মতো সাদা রঙ থাকে। এ কারণে এদের ‘চশমাপরা’ হনুমান বলে। ইংরেজি নাম PHAYRE’S LEAF MONKEY বা PHAYRE’S LANGUR। বৈজ্ঞানিক নাম TRACHYPITHECUS PHAYREI। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশকিছু চিরহরিৎ বনে এদের বসবাস।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনামে এ হনুমান দেখা যায়। ঘন চিরসবুজ বনের এ বাসিন্দা দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। প্রতিটি দলে ৪-২৬টি করে হনুমান থাকে এবং দলের নেতৃত্বে থাকে শক্তিশালী এক পুরুষ। পুরুষটিই প্রজনন বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। নারী হনুমানের প্রাপ্তবয়স্ক হতে তিন থেকে চার বছর সময় লাগে। গর্ভধারণের সময়কাল ২০৫ দিন। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে একটি করে বাচ্চা দেয় এবং এক বছর ধরে লালন-পালন করে। অনেকটা নিঃশব্দে চলাচল করা এ প্রাণি বিপদের সম্মুখীন হলে ভয়ঙ্কর শব্দ করে, যেটি ‘অ্যালার্ম কল’ নামে পরিচিত। এদের খাদ্যের তালিকায় রয়েছে- বিভিন্ন গাছের পাতা, ফল, ফুল ও পোকামাকড়।

PHAYRE'S-LANGUR

এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গবেষণাপত্রটি এখনও আমাদের হাতে আসেনি। বনের ভেতরের রাস্তাঘাট নির্মাণ নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছি। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

‘এত সতর্কতার মধ্যেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোরাকারবারিরা যে সক্রিয় নেই তা বলা যাবে না। তবে আমরা আমাদের সল্প জনবল নিয়েও চেষ্টা করে যাচ্ছি আন্তরিকভাবে’- বলেন এই বন কর্মকর্তা।

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!