Friday , April 19 2024
You are here: Home / মতামত / সীমান্ত হত্যা: বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞায় ফেলবেন :  মো. নজরুল ইসলাম নোবু
সীমান্ত হত্যা: বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞায় ফেলবেন :  মো. নজরুল ইসলাম নোবু

সীমান্ত হত্যা: বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞায় ফেলবেন :  মো. নজরুল ইসলাম নোবু

ভারত আমাদের মিত্র রাষ্ট্র। প্রতিবেশী রাষ্ট্র। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মানুষ আজীবন তাদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং ভবিষ্যতেও করবে। আজও অনেক মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত বাংলাদেশী চিকিৎসার জন্য নিয়মিত ভারত যাতায়াত করে। অনেকের আত্মীয় স্বজন এপারে ওপারে দুই পাড়েই রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক লোক ভারতে কর্মরত রয়েছে। তদ্রূপ ভারতেরও অনেকেই বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। উভয়ের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে দুই দেশেরই অনেক ভালো ভালো কাজ ও উদ্যোগ রয়েছে।
কিন্তু যখন সীমান্তের দিকে তাকাই তখন বন্ধুত্বের এক ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাই। আমাদের হতাশ হতে হয়। আঁতকে উঠতে হয় যখন ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীর মৃতদেহের দৃশ্য মানসপটে ভেসে ওঠে। কাঁটাতারের পাশে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশের আত্মচিৎকারে আকাশ বাতাস হয়তো আজো ভারী হয়ে ওঠে। উল্টো করে প্রায় ৫ ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখা হয় ফেলানীর নিথর দেহ। সত্যিকারার্থে সেদিন শুধু ফেলানীর দেহকে ঝুলানো হয় নি ; পুরো বাংলাদেশকে সেদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়। নয় বছর পেড়িয়ে  যাচ্ছে কন্যাহারা পিতা নুর হোসেন এখনো সেই হত্যার বিচার পায়নি। হয়তো পাবেও না। শুধু ফেলানী হত্যায় থেমে নেই বিএসএফ জোয়ানরা। সুযোগ পেলেই পাখির মতো গুলি মারে বাংলাদেশীদের। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী বিএসএফের আগ্রাসন আরো বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা দ্বারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৬ মাইল) দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানায় মূলত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশি নাগরিকদের উপর সংগঠিত নিয়মিত নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডকে বোঝানো হয়ে থাকে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বিশ্বের ইউএস-ক্যানাডা আর রাশিয়া-কাজাখস্তানের পর তৃতীয় দীর্ঘতম সীমানা। এর ৭০% জায়গা ৮-ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া আর ইলেক্ট্রিক তার দিয়ে সুরক্ষিত। গ্লোবাল পোস্টের মতে- এটা বিশ্বের নিকৃষ্টতম সীমান্ত । এ সীমান্তই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত, যেখানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করে নিয়মিত। চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত শ্যূট-অন-সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল আছে। যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করতে পারে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ২০১১ সালে বিজিবি ও ভারতের বিএসএফের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল৷ চুক্তিতে বলা হয়, সীমান্ত পারাপারে মানুষ হত্যায় অস্ত্র ব্যবহার করবে না এই দুটি দেশ৷ চুক্তি করেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা৷ ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে সীমান্তে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফ৷  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ ও ২০১৮ সালে ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ ২০১৮ সালে সীমান্ত হত্যা তুলনামূলক কম ছিল। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার হিসেবে ২০১৯ সালে এই সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে ৩৮ এ এসে দাঁড়ায়। বেসরকারী হিসেবে ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ জন সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক কে হত্যা করা হয়। এছাড়া মারধোর বা শারীরিক নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। গত শুক্রবার (২৬ জুন) চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে বিএসএফের হাতে নির্যাতনের শিকার দুই বাংলাদেশির মধ্যে একজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আহত করা হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তার পিঠে বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে (তথ্যসুত্রঃ ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা সংস্করণ)। জুনের ২১ তারিখে যশোরের বেনাপোল বন্দর থানার পুটখালি সীমান্তে এক যুবককে নির্যাতন করে ইছামতী নদীর তীরে ফেলে যায়।
২০২০ সালেও বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড ঘটেছে। আইন সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী শুধু জানুয়ারী মাসেই ১২ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করা। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে পঞ্চগড়ের এক শিক্ষার্থীর পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। ফলে সে মারা যায়। ২৫ জুন বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় মিজানুর রহমান নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছে। ২৯ জুন (রবিবার) জাদুকাটা নদীতে গাছ ধরতে গেলে জুয়েল নামের একজন কে গুলি করা হয়। নিহত জুয়েল সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের ঘাগটিয়া কাইকরপাড়ার আফাজ উদ্দিনের ছেলে।
প্রসঙ্গত ভারত যেসব রাষ্ট্রকে বন্ধু রাষ্ট্র মনে করে সেসব রাষ্ট্রের সীমান্তে বিএসএফের বদলে এসএসবি (সশস্ত্র সীমা বল) বাহিনী নিযুক্ত করে। যেমনটা করা হয়েছে নেপাল ও ভুটান সীমান্তে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের সাথেও ভারত সম্পর্ক খুব ভালো; বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু সীমান্তে নিযুক্ত করা হয়েছে বিএসএফ। যাদের অধিকাংশই উগ্র বা আগ্রাসী চরিত্রের। কেউ বাংলা ভাষা জানে না। এখন কথা হলো এ কেমন বন্ধুত্ব ! বন্ধুত্বের কোনো সংজ্ঞায় এভাবে সীমান্ত হত্যা যায় ? অবশ্যই  যায় না এবং তা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কর্তৃক যে পরিমাণ বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিক হত্যা করা হয়েছে তা পৃথিবীর মানচিত্রে বিরল। শত্রুভাবাপন্ন বা যুদ্ধাবস্থা ব্যতীত এভাবে সীমান্ত হত্যা পৃথিবীর কোনো দেশেই হয় না। বিএসএফের ভাষ্যমতে যাদের মারা হয়েছে বা হয় তাঁরা চোরাকারবারি, পাচারকারি, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে তারা চোরাকারবারি বা পাচারকারী তবুও তো এভাবে হত্যা বৈধ নয়। দুই দেশেই প্রচলিত আইন রয়েছে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক। কোনো আপত্তি নেই।
পৃথিবীর বহু সীমান্ত দিয়ে মাদক বা নেশা জাতীয় দ্রব্য ইয়াবা,ফেনসিডিল, মদ ইত্যাদি পাচার হয়। কই, কোথাও তো এভাবে হত্যা পরিলক্ষিত হয় না। ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার,ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান ও চীন ; তাদের সাথে এমন আগ্রাসী আচরণ ভারত দেখাতে পারে না। ওইসব দেশের একজন মারা গেলে দেশি-বিদেশি সকল পত্রিকার শিরোনাম হয়ে যায়। যুদ্ধাবস্থা তৈরী হয়ে যায়। আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণ শুরু হয়ে যায়।কিন্তু বাংলাদেশের কোনো নাগরিক মারা গেলে বড়জোর পতাকা বৈঠক হয়। এ পর্যন্তই।
অভিযোগ রয়েছে বিএসএফ মাঝে মধ্যেই নিরীহ নিরস্ত্র লোকদেরকেও আক্রমণ করে। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেও প্রবেশ করে।বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাগুলো তে প্রচুর কৃষি জমি রয়েছে। স্বভাবতই চাষাবাদের জন্য সেই সব জমিতে যেতে হয়। অনেকে গরু ছাগল চড়াতেও যায়। এতে প্রায়শই বিএসএফের রোষানলে পড়তে হয়। উনিশ বিশ হলে নির্যাতন বা গুলি করতে সামান্য কুন্ঠাবোধ করেন না।
এভাবে সীমান্ত হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। বরং তা  সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। বলা হয়ে থাকে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক অধিকতর ভালো। এ কথা আমরা সাধারণ নাগরিকরাও বিশ্বাস করি। এবং করতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। দ্বন্ধ বা সংঘাত কোনোটাই আমরা চাই না। আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতেও সেই কথা বলা আছে। বন্ধু ও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের কাছে প্রত্যাশা থাকবে সীমান্তে যেন আর একটিও প্রাণ না ঝরে। আমাদের বাংলাদেশীদেরও নৈতিকতার ও বৈধতার  জায়গা টা ঝালিয়ে নিতে হবে। অবৈধ অনুপ্রবেশ, মাদক ও চোরাকারবারি, মানব পাচার ও অন্যান্য অপকর্ম বন্ধ করতে হবে। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন ও সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে উভয় দেশের সরকারকে আরো আগ্রহী হতে হবে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের সরকারকে কঠোর হতে হবে।
লেখক :
সাবেক শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!