Wednesday , March 19 2025
You are here: Home / জাতীয় / বঙ্গবন্ধুর বাকশালের ডাকেও এত আওয়ামী লীগ আসেনি

বঙ্গবন্ধুর বাকশালের ডাকেও এত আওয়ামী লীগ আসেনি

একদিন যারা এ দেশের রাজনীতিতে স্লোগান তুলেছিলেন ‘এ সমাজ ভাঙতে হবে/নতুন সমাজ গড়তে হবে’- সেই রাজনীতির অনেক নেতা বহু আগেই নষ্ট হয়ে গেছেন। ক্ষমতা, লোভ ও স্বার্থের চোরাবালিতে ডুবে গেছেন। তাদের বিভ্রান্ত রাজনীতিতে অসংখ্য অনুসারীও নানা পেশায় জড়িয়ে সময় বদলের হাওয়ায় নিজেদের পাল্টে ফেলে কেউ রাতারাতি সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগ, না হয় বিএনপির পোশাক পরিধান করেছেন। রাজনীতিতে কত বিপ্লবীর করুণ পরাজয় ও আত্মগ্লানির জীবন আমাদের চোখের সামনেই মৃত ইতিহাস। সমাজ নষ্টের জন্য একসময় যারা বুর্জোয়া রাজনীতিকে অভিযুক্ত করে ক্ষমতানির্ভর দলগুলোকে অভিযুক্ত করে নিজেরা সাধকের বেশে পথ হাঁটতেন, তারাও দিনে দিনে সমাজকে নষ্টের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে হাসতে হাসতে ভূমিকা রেখেছেন। নষ্ট সমাজের অংশীদার হয়েছেন। এরা শুধু রাজনীতিতেই নয়, নানা পেশায় এদের বিচরণ চোখে পড়ার মতো। লাজলজ্জাহীন, নির্লজ্জ বেহায়ারা নষ্ট তথাকথিত রাজনীতিবিদদের করুণাশ্রিত জীবন নিয়ে সমাজটকে মূল্যবোধ ও আদর্শহীন অন্তঃসারশূন্য করেছেন। আর পবিত্র রাজনীতির মহান আদর্শের কেউ চিরনিদ্রায় কেউবা জীবন্মৃত হয়ে আছেন। ছোট্ট একটি অংশ পল্টন আর তোপখানায় পড়ে আছে নিবুনিবু বাতি জ্বালিয়ে। তবু সিপিবিও মার খায়।

আমাদের জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যৌবনের ১৩টি বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়ে, ফাঁসির মঞ্চেও দেশের স্বাধীনতা ও মানবকল্যাণের রাজনীতিতে মহাকাব্যের নায়ক হিসেবে ইতিহাসে অমরত্ব নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় এ দেশের একদল বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর মোশতাক ও খুনি সেনা সদস্যরা পরিবার-পরিজনসহ এই মহান দেশপ্রেমিক নেতাকে হত্যা করেছিল। সেদিন পৃথিবীর বুকে আমরা একটি বিশ্বাসঘাতক পিতৃহত্যার খুনি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। কিন্তু মহান বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে মহান আদর্শের যে বাতি জ্বলে উঠেছিল, সেখানে শত নির্যাতনের মুখেও তাঁর অগণিত অনুসারী সুসংগঠিত হয়ে লড়াই, সংগ্রাম, আত্মাহুতি, জেল-জুলুম সহ্য করে দীর্ঘ সামরিক শাসনকে জনগণের ঐক্যে কফিনে পুরেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত চেতনাগুলোকে নির্বাসনে পাঠিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করে, এমনকি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজন এবং জেলখানায় নিহত জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার হবে না বলে একটি অপরাধী জাতি হিসেবে সংবিধান ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা করে বিশ্ববাসীর সামনে কলঙ্কিত জাতি হিসেবে শাসকদের কুৎসিত চেহারা উদ্ভাসিত করেছিলাম। যে চেহারা ছিল আত্মগ্লানির ও লজ্জার এবং গভীর বেদনার। এমনকি আমরা আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে পাহাড়ের মতো কলঙ্কের বোঝা বহন করেছিলাম। জাতির জনকের নামও মুছে ফেলেছিলাম। আজ সবাই বড় বড় কথা বলেন। ’৭৫-পরবর্তী চেহারা ভুলিনি আমরা। যে মহান মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মবর্ণনির্বিশেষে জনযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের রক্তগঙ্গা ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম, সেই স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক অঙ্গীকারগুলোকেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস গৌরব আর আত্মমর্যাদার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডই ছিল আদর্শিক রাজনীতিকে হত্যা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতাকেই শুধু পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করা হয়নি, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী রাখাকালে তাঁর অনুপস্থিতিতে যাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হেঁটে আদর্শের মহিমায় জাতির আস্থার উচ্চতায় উঠে বীরের মতো নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের হত্যাই করা হয়নি, জীবিতদের খুনি ও তাদের শাসকরা অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছে। বছরের পর বছর কারাগারে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছে। অনেকে নির্বাসিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল আন্দোলনের অনেক নেতা-কর্মী সেই নির্যাতনের শিকার হলেও সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের স্টিমরোলার চলেছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর।

মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধৈর্যের অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে গণতন্ত্রের পথে ব্যালট বিপ্লবে ক্ষমতায় ফিরেছে। শেখ হাসিনাকেও কুড়িবারের বেশি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ভারতের ঐতিহ্যবাহী স্বাধীনতা-সংগ্রামী গান্ধী পরিবারের ওপর যে ট্র্যাজেডি নেমে এসেছিল, পাকিস্তানের ভুট্টো পরিবারের প্রতি যে নৃশংসতা ঘটেছিল, তার চেয়ে ভয়ঙ্করই নয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতা ঘটেছিল আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ওপর। তাঁর অনুগত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর। নিয়ত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে অদৃশ্য বুলেট তাড়া করে ফিরছে। যেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে স্তব্ধ করে দিতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্বের রাজনীতিকেই স্তব্ধ করে দেওয়া যায়।

২০০১ সালের পর আওয়ামী লীগের ওপর যে ঝড়-ঝাপটা ও দুঃসময় এসেছিল, তাও কম হৃদয়বিদারক নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ব্যালট বিপ্লবে তাঁর মহাজোটকে নিয়ে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরই নয়, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদেরও বিচারের আওতায় এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছেন। গোটা দেশ উন্নয়নের ছোঁয়ায় উজ্জ্বলতর হয়েছে।

আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক শহীদপুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যথার্থই বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে ত্যাগের মহিমায় এমন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আর কোথাও নেই। ভারতের কংগ্রেস স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল হলেও আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই দল যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নয়, অহিংস পথেই নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মহান মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এ দেশের তারুণ্য ও জনগণকে তার ক্যারিশমায় ঐক্যবদ্ধ করে মহান ভাষা আন্দোলন থেকে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে গণতন্ত্রের পথে রক্ত ঝরিয়ে ঝরিয়ে জেল-নির্যাতন সয়ে সয়ে স্বাধিকার-স্বাধীনতা ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের বাঁক ঘুরে ’৭০ সালে জনগণের রায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। আওয়ামী লীগ সেই দল পিতৃহত্যার পর এতিমের মতো নেতা-কর্মীরা জনকের মহান আদর্শ লালন করে অসহনীয় বেদনা সয়ে লড়াই করে করে ক্ষমতায় ফিরেছে। কিন্তু দুঃখ ও বেদনার বিষয় হচ্ছে, বিরোধী দলে থাকলে আওয়ামী লীগে যেমন তার নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা কম হলেও সাহসে দৃশ্যমান হয়ে থাকেন, তেমনি ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি এবং দলের প্রতি অনুগত মোটা দাগের নেতা-কর্মীরা নিজ ঘরে উপেক্ষিত হয়ে যান। নিজ ঘরে অন্তহীন অবহেলায় বেদনা সয়ে দলের কাঠামো ও নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েন। সুবিধালাভ দূরে থাক। দুর্দিনের কর্মীরা পথে পথে ঘোরেন। আর একদল সুবিধাবাদীকে নিয়ে ক্ষমতার দম্ভ ও লুটপাটে ভাসে। সরকারকে গণবিচ্ছিন্ন করে। বিগত ১১ বছরের ইতিহাসে এটা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে জানেন না, তা নয়। তাঁর বক্তৃতায় বারবার দলের সেই নিবেদিতপ্রাণ অভিমানী কর্মীদের কথা উঠে আসে।

আওয়ামী লীগের টানা ১১ বছরের ক্ষমতায় যে হারে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে দিনে দিনে আওয়ামী লীগার হয়ে গেছে, এমনটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া বাকশাল গঠনের সময়ও দেখা যায়নি। এত আওয়ামী লীগার হয়নি শত অনুরোধেও। অথচ আজ হাইব্রিড, কাউয়া, অনুপ্রবেশকারী বলার পরও নষ্টরা ক্ষমতার লোভে ছ্যাঁচড়ার মতো পড়ে থাকে দলে! আজ আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে মনে হয়, এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগার বা পাকিস্তানের দোসর রাজাকাররা তাদের কোনো সন্তান-সন্ততি রেখে যায়নি। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকার সন্তানরা এমনকি আলবদর, আলশামস থেকে নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুসারীরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব রেখে টগবগে তারুণ্যে গঠিত জাসদে কিংবা নিষিদ্ধ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সিরাজ সিকদারের আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, তেমনি এই ১১ বছরে একসময়ের আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাবিদ্বেষীরা আজ কী সুন্দর করে আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। নাটোরের তৃণমূল নেতা থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত এদেরকে হাইব্রিড ও কাউয়া বলে বারবার তিরস্কৃত করলেও লাজলজ্জাহীন বেহায়া সুবিধাভোগীরা আরও বড় আওয়ামী লীগার হয়ে উঠেছে দিন দিন। আওয়ামী লীগারদের সামনে আওয়ামী লীগ, আড়ালে কঠোর সমালোচনাÑ এ নীতিতে চলছে চতুর, ধূর্ত দলকানারা। বেশ্যা ও তার দালালদের নীতি থাকলেও এদের নীতি নেই। এদের যারা অনুপ্রবেশ করায় তারা দলের বড় বিশ্বাসঘাতক।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পঁচাত্তর- উত্তর ছাত্রলীগের দুঃসময়ে কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে বসে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাহালুল মজনুন চুন্নু। নির্লোভ, পরীক্ষিত বাহালুল মজনুন চুন্নু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি, দলের প্রতি অনুগত থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোনো পর্যায়ে তাঁর আর ঠাঁই হলো না। কত আমদানি করা ব্যবসায়ী, হঠাৎ আসা নেতা-নেত্রীরা দলের বড় নেতা হয়ে গেলেন। সারা দেশে যাদের হাতে গড়া তৈরি কর্মী রয়েছে, তাঁরা আর দলের কোথাও ঠাঁই পাননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের আন্দোলনে মাঠের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। এখন মৌলভীবাজারে আওয়ামী লীগ সম্মেলনে ছাত্রলীগ দুই দলে সংঘর্ষ করে। কী অসভ্যতা! স্বাধীনতা সংগ্রামী ছাত্রলীগ নেতাদের অনেকেই বিচ্যুত হয়েছেন।
অনেকেই এখনো দলে পড়ে আছেন। কিন্তু সরকার বা দলের শক্তিশালী কাঠামোতে জীবিতদের ঠাঁই হচ্ছে না এখনো। ষাটের দশকে দুবার সাধারণ সম্পাদক পদে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসা আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দুবার দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের আর কোনো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে উঠে আসতে পারেননি। রাজনীতি ও সমাজে, ইতিহাসে এমনকি সংসদেও গণতন্ত্রের আন্দোলনে তাঁরা আলোকিত হলেও দলে যেন অবহেলার শিকার। মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বাকশালের অন্যতম সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার পর জাসদের জন্ম দিয়ে রাজনীতির রহস্যপুরুষ হয়ে নির্বাসিত হয়েছেন। আবদুর রাজ্জাক চিরনিদ্রায় শায়িত। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ডাকসু ভিপি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান জীবন্ত কিংবদন্তি তোফায়েল আহমেদ মেধা, মননে রাজনীতিতে আলোকিত হয়ে থাকলেও সরকার বা দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামে নেই। ষাটের আরেক ছাত্রলীগ নেতা পঁচাত্তর-উত্তর আওয়ামী লীগের অসাধারণ সংগঠক মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার দুঃসময়ের ডান হাত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু শারীরিকভাবে এখনো সক্ষম থাকলেও সরকারেও নেই, দলের প্রেসিডিয়ামেও নেই। ওবায়দুল কাদেরের পর ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ডাকসু ভিপি হয়ে রাজনীতিতে আদর্শিক ধারায় আলোকিত হয়ে ওঠা মাঠকর্মীদের প্রিয়জন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ মুজিবকোট পরে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে আর্তনাদ করলেও দলীয় কাঠামোয় ফিরে আসবেন কিনা, তা অনিশ্চিত। ’৭১-এ ভাইহারা, ’৭৫-এ কঠিন নির্যাতনের শিকার মুকুল বোস দলের উপদেষ্টা পরিষদে ঠাঁই পেলেও আজ পর্যন্ত না সংসদ নির্বাচনে তার ভাগ্যে জুটেছে মনোনয়ন, না দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই পাবেন সেই নিশ্চয়তা এখনো নেই। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কর্মীবান্ধব আবদুল মান্নানের ওয়ার্কিং কমিটিতে ফিরে আসা হবে কিনা, তাও কেউ জানে না। জানে না সাবেক ডাকসু ভিপি আখতারউজ্জামান ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের কী হবে? মোজাফফর হোসেন পল্টুরা কী এভাবেই বিদায় নেবেন উপদেষ্টাম-লীতে থেকে? ’৯০-এর ছাত্র আন্দোলনের নেতা শফি আহমেদ দলে এসে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে কর্মীবান্ধব তৃণমূল নেতা হয়ে না পেলেন মনোনয়ন না ওয়ার্কিং কমিটিতে মিলল ঠাঁই!

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি চির-অনুগত ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ ছেড়ে দেওয়ার পরও দীর্ঘদিন সংগঠনের অভিভাবকত্ব করেছেন। তাঁর হাতে তৈরি আওয়ামী লীগের মাঠের প্রতিটি নেতা-কর্মী কাছে থেকে তাঁর চেনা ও জানা। দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে তিনি সব সময় বক্তৃতায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনীতির ভাষায় শালীনতার সঙ্গে আঘাত করতে যেমন ভুল করেন না, তেমনি দলের উন্নাসিক, দাম্ভিক নেতা-কর্মীদেরও সতর্ক করতে ভুল করেন না। এমনকি দুর্দিনের ত্যাগীদের কথাও বারবার বলেন। সেতুমন্ত্রী হিসেবে তিনি সাফল্যের নজির রেখেছেন। বিগত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহল যতই প্রশ্ন করুক মহাজোটকে সঙ্গে রাখা, অন্যদিকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে সারা দেশ সফর করে গণজাগরণ ঘটাতে সফল হয়েছেন। নির্বাচনের আগেই চিকিৎসকরা তাঁর চিকিৎসা নেওয়ার জন্য তাগিদ দিলেও তিনি তা অবজ্ঞা করে দলের দায়িত্বকেই বড় করে দেখেছেন। নির্বাচনের পরও চিকিৎসকদের আশ্রয়ে না গিয়ে সকাল-রাত্রি দলের কাজেই ডুবে থেকেছেন। এজন্য তাঁকে কঠিন শারীরিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দলের অগণিত নেতা-কর্মী ও শোকবিহ্বল মানুষের দোয়া-ভালোবাসায় এবং শেখ হাসিনার বড় বোনের মতো তৎক্ষণাৎ দায়িত্ব পালনে আল্লাহর রহমতে আজরাইলের দরজা থেকে ফিরে এসেছেন। ফিরে এসে এখন সারা দেশে দলের সম্মেলন নিয়ে সফর করে বেড়াচ্ছেন। সকাল-রাত্রি দলের জন্য নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। যদিও এসব সম্মেলনে আমু-তোফায়েলদের নেওয়া হলে সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়ত।

মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছেন দল থেকে সেখানে ওবায়দুল কাদের তাঁর পাশে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যার সততার রাজনীতি থেকে পাঠ নেওয়ার যে আকুতি জানিয়েছেন, তা সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও তাঁর নির্লোভ, গণমুখী, কর্মীবান্ধব, দেশপ্রেমিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আওয়ামী লীগই নয়, সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যদি হৃদয় দিয়ে লালন করতেন এবং বিশ্বাস করে অনুসরণ করতেন আজকের বাংলাদেশ এত দিনে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াকে অতিক্রম করে যেত। রাজনীতি-সমাজ এতটা নষ্ট হতো না। আদর্শিক রাষ্ট্র হতো বাংলাদেশ। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বক্তৃতাও মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। তিনি যে আন্তরিকভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছেন সেই বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। দুদকে আরও পেশাদার সৎ কর্মকর্তাকে যুক্ত করে এটিকে আরও লোকবলে শক্তিশালী করা অনিবার্য।

ইতিমধ্যে দলের সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন থেকে বিতর্কিত নেতৃত্ব বাদ দিয়ে যে সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা নেতৃত্ব বহাল হচ্ছে। শ্রমিক লীগের এক নেতা ও ঢাকা উত্তরের স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা ছাড়া কারও বিরুদ্ধে কোনো বিতর্ক এখনো ওঠেনি। ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণে দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া ত্যাগী নেতৃত্ব উঠে আসায় দলের খাঁটি নেতা-কর্মীরা আশার আলো দেখছেন। শেখ ফজলে শামস পরশকে যুবলীগ চেয়ারম্যান করা চমক হয়েছে। রাজনীতিবিমুখ তারুণ্যকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন এই মেধাবী সন্তান।

আওয়াম লীগ নেতৃত্বকে তৃণমূল থেকে সব শাখা সংগঠনের নেতৃত্ব ঘোষণার পাশাপাশি সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কমিটি চূড়ান্ত না করলে পরবর্তীতে বিতর্কিতদের বা সুবিধাভোগীদের প্রবেশের সুযোগ থেকে যাবে, এটি বিবেচনায় নিতে হবে। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে দলের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা যতই বলুন, তিনি চান নতুন নেতৃত্ব আসুক। কিন্তু গোটা দেশ জানে শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। তিনি না চাইলেও, নেতা-কর্মীরা তাঁকেই নির্বাচিত করবেন। সাধারণ সম্পাদক পদে অনেকের নাম শোনা গেলেও নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করছেন না। এমনকি ওবায়দুল কাদের নিজেও বিগত সম্মেলনের মতো বলছেন, তিনিও প্রার্থী নন। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সমগ্র দেশের নেতা-কর্মীদের ধারণ করার মতো সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরের বিকল্প নেতৃত্ব জাতীয়ভাবে পরিচিতির দিক থেকে, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের দিক থেকেও আর কেউ নেই, এটাই অপ্রিয় সত্য। একসময় আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির একজন সদস্য রাজনীতিবিদ হিসেবে সারা দেশের মানুষের কাছে বড় নেতা ছিলেন। এখন অনেক দায়িত্বশীল জায়গায় থাকা নেতাদের প্রতিও মানুষের সেই আগ্রহের জায়গা নেই। এটা উপলব্ধি করে একটা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসেবে আগামী দিনের আওয়ামী লীগের প্রবীণ-নবীনের যোগ্য নেতৃত্বের ওয়ার্কিং কমিটি নির্বাচনে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার পাশে থেকে ওবায়দুল কাদেরের দায়িত্ব নিয়ে ভূমিকা রাখা সময়ের দাবি। শহীদ তাজউদ্দীনপুত্র সোহেল তাজকে দলীয় কাঠামোয় যেমন ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন, তেমনি ছাত্ররাজনীতি থেকে এখনো অবিচল শেখ হাসিনার পাশে থাকা মিডিয়াবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব, আমলাবান্ধব ও কর্মীবান্ধব আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের মতো নেতাদেরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে আসা উচিত। দলের বর্তমান প্রেসিডিয়ামে থাকা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর রাজনীতির অতীত বর্ণাঢ্য। বার্ধক্যজনিত রোগে তিনি আক্রান্ত। মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. আবদুর রাজ্জাক ছাড়া আর কাউকে মানুষ তেমন চেনে না। দলের নেতা-কর্মীদের কোনো যোগাযোগ নেই। এখানে এখনো আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদদের ফিরিয়ে এনে বিতর্কিতদের নির্বাসনে দিয়ে প্রবীণ-নবীনের আলোকিত নেতৃত্বে দলকে সাজানোর চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে।

যাক, শুরুতে বলছিলাম সমাজটা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, দুর্নীতির টাকায় বিরিয়ানি খাওয়ার চেয়ে, নুন-ভাত খাওয়া তৃপ্তির। নষ্ট সমাজের অস্থির-অশান্ত প্রতিযোগিতায় এ দেশের রাজনীতি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির শক্তিধর মধ্যবিত্ত শ্রেণিও ভেঙে যাচ্ছে। একটি অংশ লোভের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় চারদিকে। লাখ লাখ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, যারা ব্যাংক লুট করেছে, ব্যাংকের টাকা না দিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছে, শেয়ারবাজার লুট করেছে, সরকারি সব দফতরে যত দুর্নীতি চলছে সবাইকে আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবি। আওয়ামী লীগ একমাত্র মহান বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নির্লোভ নেতা-কর্মীনির্ভর সংগঠন দাঁড় করাতে পারলে গণমুখী রাজনীতিতে আদর্শের সত্তার রাজনীতি দিতে পারলেই সমাজকে রক্ষা করতে পারবে। আর চলমান সম্মেলন ও জাতীয় সম্মেলনে সে নেতৃত্ব তুলে আনার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। আওয়ামী লীগকে সম্মেলন সামনে রেখে দলীয় শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি উপলব্ধি করতে হবে, পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ দুঃসময়ে যাঁরা অবদান রেখেছেন, যাঁরা মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে যাঁরা সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদেরই দলে অগ্রাধিকার দেওয়া, বিবেচনার সময়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যের প্রতীক শেখ হাসিনাই পারেন ভুল করে, অভিমানে যাঁরা দল ও দলের কাঠামোর বাইরে অথচ আজীবন অন্তরে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু তাঁদের ফিরিয়ে এনে এক শক্তিশালী দল দিতে। আজকাল চারদিকে তাকালে এত আওয়ামী লীগার দেখি মনে হয়, এ দেশে মুসলিম লীগাররা আওয়ামী লীগবিরোধী সন্তান রেখে যাননি। এ দেশে মুজিববিদ্বেষী, কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধী জাসদ, বাসদ এমনকি দুঃসময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র ইউনিয়ন বা চীনাপন্থি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে এমনকি কেউ ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের সঙ্গেও জড়িত ছিল না। সবাই ছিল ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ। মনে রাখবেন, কাল দল ক্ষমতায় না থাকলে দলের অফিসে, রাজপথে চেয়ার ফাঁকা থাকবে। সুবিধাবাদীরা সবাই ক্ষমতার ছায়ায় আস্তে আস্তে চলে যাবে। পেশাজীবী দলবাজরা সাচ্চা পেশাজীবী হয়ে যাবে। নেতা-কর্মীদের ওপর কঠিন নির্যাতন নামবে। তখন প্রতিরোধ করার মতো আদর্শিক নেতৃত্বনির্ভর কর্মীর দল গড়ার এখনই সময়। ক্ষমতার করুণা, বিভিন্ন পেশার মানুষকেও কতটা নির্লজ্জ করে ১১ বছর তা দেশে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এটা ভয়ঙ্কর।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!