প্রতি মাসে ভাড়া আর অনভিজ্ঞ হাতে ব্যবহারের কারণে মিটার লক হওয়ার পর বাড়তি ব্যয়ে বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার হয়ে উঠেছে এখন গ্রাহকের গলার কাঁটা। তবে, বিতরণ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, তারা সরকার নির্ধারিত হারেই ভাড়া নিচ্ছেন।
প্রিপেইড মিটারের এই ভাড়া ঠিক করলো কে? এমন প্রশ্নে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মিটার ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে। আর মিটার ভাড়া ঠিক করতে মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করেছে পাওয়ার সেল।
একটি প্রিপেইড মিটারের মূল্য কত—এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জিএম (বাণিজ্য) মীর কাউসার আমীর আলী বলেন, ‘সবশেষ দরপত্র অনুযায়ী মিটারের মূল্য পড়েছে ২৮ ডলার। অর্থাৎ দেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরে) দুই হাজার ২৪০ টাকা। এর বিপরীতে একজন গ্রাহককে প্রতিমাসে ৪০ টাকা করে মিটারটির ভাড়া দিতে হচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে, গ্রাহক ৫৬ মাসেই এই পরিমাণ ভাড়া পরিশোধ করেন। অর্থাৎ সাড়ে চার বছরেই একটি মিটারের মূল্য পরিশোধ হয়ে যাওয়া কথা। কিন্তু গ্রাহক একবার মিটারটি ভাড়া নিলে তাকে আজীবন ভাড়া পরিশোধ করতে হয়।
একটি মিটারের আয়ুষ্কাল কত দিন জানতে চাইলে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) এটিএম হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘মিটারগুলোর গড় আয়ুষ্কাল ১০ বছর। তবে কোনও মিটার এর চেয়ে কম দিন বা বেশি দিনও চলতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘গ্রাহক আমাদের কাছ থেকে মিটার ভাড়া নিলে আমরা তাকে সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। এই সেবার মধ্যে মিটার অকেজো হলে তা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়।’
গড় আয়ুষ্কাল ১০ বছর ধরে হিসাব করলে একটি মিটারে ১০ বছরের আয় হওয়ার কথা প্রতি মাসে ৪০ টাকা হিসেবে চার হাজার ৮০০ টাকা। অর্থাৎ দুই হাজার ২৪০ টাকার মিটারে ১০ বছরে একটি বিতরণ কোম্পানি দুই হাজার ৫৬০ টাকার ব্যবসা করছে। আর গ্রাহক আজীবনই এই অর্থ পরিশোধ করতে থাকবে।
বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, কেউ মিটার কিনে লাগালে তাকে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে না। কিন্তু বাজারে এখনও প্রিপেইড মিটার পাওয়া যায় না। আর বিতরণ কোম্পানিরও মিটার বিক্রির কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে মিটার ভাড়াই নিতে হচ্ছে গ্রাহককে।
গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয়ের পাশাপাশি মিটার ভাড়া দিয়েও বাড়তি অর্থ আয় করছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু তার কোনও হিসাব আলাদা করে রাখছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিটার ভাড়ার আয় আড়াল করতেই বিতরণ কোম্পানিগুলো হিসাব আলাদা করছে না। যদিও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বলছে, মিটার ভাড়ার আয় এখন থেকে আলাদা করেই দেখাতে হবে।
মিটার ভাড়ার পাশাপাশি নতুন ব্যবহারকারীদের কাছে প্রিপেইড মিটারের আতঙ্ক হচ্ছে—মিটারটি হঠাৎ করেই লক হয়ে যাওয়া। বিতরণ কোম্পানি বলছে, গ্রাহক মিটারটি ভুলভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করলে মিটারটি লক হতে পারে। একবার লক হলে সেটি খুলে দিতে ৬০০ টাকা করে নেওয়া হয়। মূলত গ্রাহক যেন কারসাজি করতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
মনোয়ার হোসেন নামে একজন প্রিপেইড গ্রাহক জানান, তাকে কীভাবে এই মিটার দেওয়া হলো, কীভাবে এই মিটারের টাকা পরিশোধ হবে, সে সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি। এখন তিনি দেখছেন প্রতিমাসে ৪০ টাকা করে মিটার ভাড়া কেটে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মিটারগুলো বসানোর সময় পুরনো মিটারগুলো খুলে নেওয়া হয়েছে। আর আমার কাছ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছেন ঢাকার একটি বিতরণ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।’
এই প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, ‘মিটার ভাড়া বাবদ বিতরণ কোম্পানিগুলো যে ভাড়া নেয়, সেটি কার সিদ্ধান্তে হয়েছে বা কীভাবে হয়েছে, তার সঠিক কোনও ব্যাখ্যা বিতরণ কোম্পানিগুলো দিতে পারছে না। অথচ বছরের পর বছর গ্রাহকরা ভাড়া দিয়েই যাচ্ছেন। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এনার্জি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত ফি-এর বাইরে আমরা কোনও ভাড়া দেওয়ার পক্ষে নই। এই বিষয়ে আমরা বারবার বলেছি। কমিশনকে চিঠিও দিয়েছি।’
শামসুল আলম বলেন, ‘কমিশনের নির্ধারিত ফি-এর বাইরে বিতরণ কোম্পানিগুলো যে মিটার ভাড়া নিচ্ছে, তা আইনসম্মত নয়।’ তিনি বলেন, ‘কমিশন জানিয়েছে তারা আমাদের চিঠি পেয়ে কাজ শুরু করেছে। বিদ্যুতের নতুন আদেশের সঙ্গে সেটির সুরাহা হতে পারে।’ তবে সুরাহা না হলে আদালতে যাবেন বলেও তিনি জানান।