দেশের পুরোনো-নতুন, ছোট-বড় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাঙনের ঘটনা ঘটে চলেছে। ভাঙনে জর্জরিত দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন জোটের দু’একটি থাকলেও অধিকাংশই বিরোধী অংশ বা জোটের। এ বিরোধী অংশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ঐক্যের আহ্বান জানালেও নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছে না। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে দল ভেঙে নতুন প্লাটফর্ম দাঁড় করাচ্ছেন নেতারা। গঠনমূলক রাজনীতি-চর্চার অনুপস্থিতির কারণেই দলগুলোতে এভাবে ভাঙন চলছে বলে মত বিশ্লেষকদের। তারা উদ্বেগ জানিয়ে বলছেন, বিরোধী অংশের এভাবে ভাঙনে জর্জরিত হয়ে পড়া গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবশেষ ভাঙনের মুখে পড়েছে সরকারবিরোধী আন্দোলনের আলোচিত প্লাটফর্ম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন এই দল থেকে সিনিয়র এক নেতাকে বহিষ্কার করাকে কেন্দ্র করে সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতনের নেতৃত্বে একটি অংশ বেরিয়ে গেছে। সম্প্রতি আবদুল মালেক রতনসহ আট নেতা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, তারাই মূল জেএসডি। এমনকি জেএসডির আগামী সম্মেলনকে অবৈধ দাবি করে কনভেনশনের ডাকও দিয়েছেন রতনপন্থিরা।
সম্প্রতি ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দল কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিও (এলডিপি)। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জেরে অলি আহমদকেই বাদ দিয়ে একই নামে আরেকটি দলের ঘোষণা দেন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। সংবাদ সম্মেলন করে তার নতুন প্লাটফর্ম ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন এলডিপির পদবঞ্চিত নেতারা। যদিও এরপর সম্প্রতি এলডিপির এক সভায় সেলিমের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন অলির অনুসারীরা।
এছাড়া সরকারবিরোধী অংশের প্রধান দল বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করেছেন বা সরে গেছেন দলটির বেশ কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য।
তাছাড়া গত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থেকেও সমমনা কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে আরেকটি জোট গড়ে তোলেন এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ।
সরকারবিরোধীদের পাশাপাশি নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে ফাটলের নজির দেখা গেছে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দলগুলোতেও। সম্প্রতি দুই ভাগে সম্মেলন করেছে ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
পার্টির একটি অংশে সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্ব থাকলেও আরেকটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন পলিটব্যুরোর সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদসহ ছয় নেতা। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নাম দিয়ে আনা নতুন প্লাটফর্মে সভাপতি নুরুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ।
জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আরও আগেই ভেঙে যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ জাসদ নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটান শরীফ নুরুল আম্বিয়া।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ভাঙন-বিভক্তিকে রাজনীতি-চর্চার অনুপস্থিতি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশে রাজনীতির অনুপস্থিতির কারণেই ভাঙনের মুখে পড়ছে দলগুলো। পাশাপাশি আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বিধায় এসবকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, আর তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটছে ভাঙনের মধ্য দিয়ে। যা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা এমন ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাথমিক পথ বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখন তো দেশে রাজনীতি নেই। রাজনীতি সব ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা নেওয়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা নেওয়া এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের প্রক্রিয়া- সেই পরিস্থিতি তো এখন বিরাজ করছে না। এখন তো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের ভোটের দরকার নেই, জনগণের সমর্থনের দরকার নেই। রাজপথের শক্তি ব্যবহার করে, কোনও কোনও বৈদেশিক রাষ্ট্রের সহযোগিতা নিলেই এবং আমাদের প্রশাসন অনুগত থাকলেই ক্ষমতায় যাওয়া যায়।
তিনি বলেন, রাজনীতিই তো নেই। হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি। এই সব দল করে এই সব করে কী লাভ হবে? পুরোটাই একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। আমরা একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এটা হতাশা-নিরাশা এবং রাজনীতির অনুপস্থিতি- তারই প্রতিফলন বলে আমি মনে করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, ভাঙা গড়া তো প্রকৃতির নিয়ম। ভাঙবে-গড়বে, নতুন করে আবার সংগঠিত হবে এটাই নিয়ম। আমাদের দেশে আমরা যেটা দেখি, খুব নিয়মিতভাবেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। সেটা রাজনীতির জন্য খুব ভালো লক্ষণ নয়। আমাদের রাজনীতি এখন আদর্শের পরিবর্তে স্বার্থের জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে। রাজনীতিবিদ যারা আছেন, তাদের একটা বিরাট অংশ নিজের স্বার্থে, ব্যক্তিস্বার্থে, একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থে রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন। আর্থিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন। সে কারণে রাজনীতিতে যে আদর্শের জায়গা থাকার কথা সেই জায়গা কিছুটা দূরে সরে গেছে।
এ শিক্ষাবিদ ও রাজনীতি-বিশ্লেষক বলেন, আদর্শের জায়গা না থাকলে যেটা হয় সেটা হচ্ছে সংকীর্ণ স্বার্থ নিয়ে সংঘর্ষ বাঁধে। এই লক্ষণটি একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ভালো নয়।