চলতি বছরের মার্চ মাসে ঠাকুরগাঁয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় অজ্ঞাত রোগে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। হঠাৎ এই মৃত্যুর পর পরীক্ষা চালিয়ে মৃত ব্যক্তিদের একজনের দেহে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। আইইডিসিআরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মৃতদের সবার জ্বর, মাথাব্যথা, বমি ও মস্তিস্কে ইনফেকশনের (এনসেফালাইটিস) উপসর্গ ছিল।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কোনও ওষুধ না থাকায় সংক্রমণ ঠেকাতে সচেতনতার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, নিপাহ এমন একটি ভাইরাস যা পশু-পাখি থেকে মানুষে ছড়ায়। বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস মূলত ছড়ায় বাদুড়ের মাধ্যমে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ সময়টাতে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়, আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে। পাশাপাশি বাদুড় হাঁড়িতে মল-মূত্র ত্যাগ করায় ও রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যাওয়ায় ভাইরাস সংক্রমণের শঙ্কা থাকে। কাঁচা রস খেলে মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
গবেষকরা বলছেন, নিপাহ ভাইরাসের কোনও ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে ৭০ থেকে ১০০ ভাগ। আর বেঁচে যাওয়া রোগীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ ভাগ স্নায়বিক দুবর্লতায় ভুগতে থাকেন। তাই সচেতনতাই প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।
শীতকালে খেজুরের কাঁচা রস পান করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক করে আসছি। কিন্তু চলতি বছরেও খেজুরের রস উৎসব পালিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, এই রোগে আক্রান্ত হলে কোনও চিকিৎসা নেই। ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নিপাহতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার শতকরা ৭০ ভাগ।
আইইডিসিআরের গবেষণা থেকে জানা যায়, শুধু রস পান করে নয় বরং ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীদের প্রায় অর্ধেক আক্রান্ত হয়েছে রোগীদের সেবা করার সময়।
নিপাহর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, খেজুরের রস সংক্রান্ত যেকোনও আয়োজন থেকে বিরত থাকতে হবে। খেজুরের রস না খাওয়ার পাশাপাশি বাদুড়ের খাওয়া কোনও আংশিক ফল খেলেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার পর সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত সম্ভব সরকারি হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
এদিকে, সোমবার (৯ ডিসেম্বর) সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত নিপাহ ভাইরাস বিষয়ক এক সম্মেলনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি মারাত্মক মহামারির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। রয়টার্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিপাহ আক্রান্তদের চিকিৎসায় কোনও ওষুধ কিংবা টিকা উদ্ভাবন না হওয়ায় এতে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৯০ শতাংশ।
সম্মেলনের সহ-আয়োজক কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন্সের ( সিইপিআই) প্রধান নির্বাহী রিচার্ড হ্যাচেট বলেছেন, নিপাহ ভাইরাস শনাক্তের পর ২০ বছর কেটে গেছে। তবে এর বিপরীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি সামলানোর পর্যাপ্ত উপকরণ এখনও বিশ্বে নেই। এই ভাইরাসের প্রার্দুভাব এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ হলেও এটি মারাত্মক মহামারিতে রূপ নিতে পারে বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, ২০০১ সালে প্রথম মেহেরপুরে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা চিহ্নিত হয়। এখন পর্যন্ত নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, রংপুরসহ দেশের ৩১টি জেলায় নিপাহর সংক্রমণ দেখা গেছে।
২০০১ সালে নিপাহতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ জন, মারা গেছেন ৯ জন। ২০০২ সালে মারা গেছেন ৮ জন, ২০০৩ সালে ১২ জন আক্রান্ত হলেও কোনও মৃত্যু নেই, ২০০৪ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭ জন আক্রান্ত হন এবং মারা যান ৫০ জন, ২০০৫ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ জন আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১১ জন, ২০০৬ সালে কেউ আক্রান্ত হননি, মৃত্যুর সংখ্যাও শূন্য, ২০০৭ সালে আক্রান্ত হন ১৮ জন এবং মারা যান ৯ জন, ২০০৮ সালে আক্রান্ত হন ১১ জন ও মারা যান ৯ জন, ২০০৯ সালে চারজন আক্রান্ত হলেও কেউ মারা যাননি, ২০১০ সালে আক্রান্ত হন ১৮ জন এবং মারা যান ১৬ জন, ২০১১ সালে আক্রান্ত হন ৪২ জন এবং মারা যান ৩৬ জন, ২০১২ সালে আক্রান্ত হন ১৮ জন এবং মারা যান ১৩ জন, ২০১৩ সালে আক্রান্ত হন ২৬ জন আর মারা যান ২২ জন, ২০১৪ সালে আক্রান্ত হন ৩৮ জন আর মৃত্যু হয় ১৫ জনের। ২০১৫ সালে আক্রান্ত হন ১৮ জন, মারা যান ১১ জন, ২০১৬ সালেও কেউ আক্রান্ত হননি, তবে ২০১৭ সালে আক্রান্ত হন ৩ জন, মারা যান দুই জন, ২০১৮ সালে চার জন আক্রান্ত হলেও মারা যান দুই জন এবং ২০১৯ সালে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া আট জনের মধ্যে চার জন মারা গেছেন।
এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিপাহ ভাইরাসে ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩১৩ জন, আর মৃত্যুবরণ করেছেন ২১৭ জন।
আইইডিসিআরের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঘটনা শনাক্ত হয় মালেয়শিয়াতে। পরে সিঙ্গাপুর হয়ে ফিলিপাইন ও ভারতে এবং সর্বশেষ বাংলাদেশে নিপাহর সংক্রমণ বেড়েছে। ২০১৮ সালে ভারতের কেরালাতে ২১ জন আক্রান্ত হয়ে ২০ জন মারা যান। এর আগে ২০০১ সালে শিলিগুড়িতে ৬৬ জন আক্রান্ত হয়ে ৪৫ জন মারা যান, ২০০৭ সালে নদীয়াতে পাঁচ জন আক্রান্ত হয়ে পাঁচ জনই মারা যান বলে জানান তিনি।
মহামারি ঠেকাতে আইইডিসিআর কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জানতে চাইলে ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, আমরা সার্ভিলেন্স কার্যক্রম চালাচ্ছি। নিয়মিতভাবে রোগী শনাক্তের পাশাপাশি আউটব্রেক হলে তার ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তবে শীতের সময় খেজুরের রস ও বাদুড়ে খাওয়া ফল এড়িয়ে যেতে বলেছেন তিনি। আক্রান্ত রোগীকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও সাবধানতা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি।