Tuesday , February 11 2025
You are here: Home / Uncategorized / বুদ্ধিজীবী হত্যা-২ বাঙালির বিবেক সাংবাদিকরাই প্রথম নিশানা

বুদ্ধিজীবী হত্যা-২ বাঙালির বিবেক সাংবাদিকরাই প্রথম নিশানা

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান
সব দেশেই সাংবাদিকরা জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সাংবাদিকরা আরও সাহসী ও সমুজ্জ্বল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ২৫ মার্চের পর অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকেও তারা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা তা জানত। তাই পরাজয় আসন্ন জেনে জাতির বিবেক সাংবাদিকরাই হয় তাদের প্রথম নিশানা। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের অপহরণ ও হত্যা মামলায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহিদ রেজা নূর। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন মাত্র তিন বছরের শিশু। বড় হয়ে তিনি তার মা ও ভাইয়ের কাছ থেকে তার বাবার অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছেন। সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূর ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তার একাংশে তিনি বলেন : “১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘এতদিনে’ শিরোনামে একটি লেখা বের হয়, যেখানে আমার বাবা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের অবস্থান সম্পর্কে সমালোচনা করেন। সে সময় আমার বাবা দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় ব্ল্যাক আউট চলছিল। রাত ৩টা-সাড়ে ৩টার দিকে দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শোনা যায়। আমার মেজো ভাই শাহীন রেজা নূর ঘুম থেকে উঠে শুনতে পান, বাড়িওলা তাকে ডেকে বলছে- ‘শাহীন দরজা খোলো’। আমার ভাই দরজা খুলে দেখতে পায় বাড়িওলা, তার দুই ছেলে এবং তার শ্যালক দরজার বাইরে দাঁড়ানো ছিল। তিনি আরও দেখতে পান, ৬-৭ জন সশস্ত্র লোক কেউ মাফলার, কেউ মাংকি ক্যাপ বা অন্য ধরনের কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ জোরপূর্বক আমার বাবার শোবার ঘরে ঢুকে যায় এবং আমার বাবাকে লক্ষ্য করে বলে ‘হ্যান্ডস আপ’। তখন আমার বাবা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় আলনার দিকে যাচ্ছিলেন। সেখান থেকে একটি পাঞ্জাবি নেন গায়ে দেওয়ার জন্য; কিন্তু তা পারেননি। সশস্ত্র ব্যক্তিরা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করে। এরপর বন্দুকধারী ব্যক্তিরা গামছা দিয়ে আমার বাবার চোখ বেঁধে নগ্ন পায়ে নিয়ে যায়। এটাই ছিল আমার বাবা প্রথিতযশা সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন সাহেবের শেষ যাত্রা। পরবর্তীকালে বিজয়ের পর ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ যখন জানা গেল, রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে, তখন আমাদের স্বজনরা সেখানে যান; কিন্তু গলিত-বিকৃত লাশের মধ্যে আমার বাবার লাশটি শনাক্ত করতে পারেননি।”

সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূরের সাক্ষ্য হতেই উঠে এসেছে বর্বরতার প্রকৃতি। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদের স্বজনদের এ বেদনা জাতি কোনোদিন বিস্মৃত হবে না। ১৯৭১ সালে ঘটনার সময় সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূর ছিলেন একজন শিশু। বাবার স্নেহ-আদর কি তিনি পেয়েছেন? শহীদ পিতার প্রতি নির্মমতা তাকে এবং শহীদের স্বজনদেরও চরম নির্মমতায় নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু তারপরও শহীদের পরিবার থেমে থাকেনি। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সেই শিশুসন্তান এই মামলার সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূর ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রো ফিন্যান্স বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। শত প্রতিকূলতা শহীদের পরিবারের আদর্শ, সাহস, দৃঢ়তার কাছে হার মেনেছে।

শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হকের অপহরণ ও হত্যা মামলায় তার ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ৫ বছর। তিনি বড় হয়ে মা ও পরিবারের মুরব্বিদের কাছ থেকে তার বাবার অপহরণের কথা জানতে পেরেছেন। তাদের কষ্ট শহীদ সৈয়দ নাজমুল হকের লাশ তাদের পরিবার কখনও খুঁজে পায়নি।

সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুলের সাক্ষ্যের কিয়দংশ : ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে যখন পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তৎপরবর্তীকালে আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দু’বার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আটক রাখা হয় এবং অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও আমার বাবা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানিরা তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

আমার মায়ের কাছ থেকে জেনেছি যে, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত অনুমান ৪টার সময় আলবদর বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল আমাদের ৯০নং পুরানা পল্টন বাসায় এসে দরজা জোরপূর্বক ভেঙে ফেলে এবং ৬-৭ জনের একটি দল ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন আমার বাবা, মা, আমার এক বোন ও আমি দোতলার সিঁড়িতে আশ্রয় নিই। এ সময় আলবদররা আমার বাবার নাম ধরে ডাকে। এরা সবাই মুখোশ পরা ছিল। তখন আমার বাবা নিচে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। তখন তারা তাকে অস্ত্রের মুখে আমার বাবাকে আটক করে ধরে নিয়ে একটি গাড়িতে তোলে।

আমরা ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর পর থেকে আমার বাবাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুর জল্লাদখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আমার বাবার লাশ পাইনি।’

এই সাক্ষীর সাক্ষ্য হতেও পাওয়া যায় বর্বরতার আরেক চিত্র। বাবাকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাবার লাশটিও খুঁজে পাওয়া গেল না। ঘটনার ভয়াবহতা কেবল শহীদের পরিবারকে শোকে মুহ্যমান করেনি। দৈনিক পূর্বদেশের ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ‘আলবদরের নরপিশাচরা ওদের হূৎপিণ্ড টেনে বের করেছে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয় হয়- বাংলার এসব সুসন্তানকে খুনিরা প্রথমে মোহাম্মদপুরস্থ ফিজিক্যাল ট্রেনিং স্কুলে নিয়ে যায় এবং রায়েরবাজারের ইটখোলার কাছে বধ্যভূমিতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। সৈয়দ নাজমুল হকের ভাগ্যেও এই ঘটেছে।

শহীদ সাংবাদিক গোলাম মোস্তফার ভাই গোলাম রহমান দুলু ছিলেন তার ভাইয়ের অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ২২-২৩ বছর। এই মামলার অপর সাক্ষী শহীদ গোলাম মোস্তফার ছেলে অনির্বাণ মোস্তফা। পেশায় তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ তার জন্ম। বাবার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন ৯ মাসের শিশু।

আ ন ম গোলাম রহমান ওরফে দুলু ট্রাইব্যুনালে বলেন-‘১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই আমরা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, ঠিক সেদিন ভোর ৬টার দিকে আমার ভাবির (আ ন ম মোস্তফা সাহেবের স্ত্রী) বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দোহা সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে একটি জিপে কয়েকজন মিলিশিয়া ও আলবদর আমাদের বাসার সামনে এসে থামে। সেদিন আমার বড় ভাই তার ৯ মাসের বাচ্চা অভিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। এরই এক পর্যায়ে আগত আলবদর ও মিলিশিয়ারা আমাদের বাসার দরজায় কড়া নাড়ে। কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আমার ভাইই দরজা খুলে দেন। আগত লোকেরা আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করে, তিনি আ ন ম গোলাম মোস্তফা কিনা। তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। ২-৩ জন মুখোশধারী লোক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বাকি বেশ কয়েকজন মিলিশিয়া ছাই রঙের পোশাক পরিহিত অবস্থায় অস্ত্র হাতে বাইরে অবস্থান করছিল। আমার বাবা-মাসহ আমরা সবাই কান্নাকাটি করতে থাকি। আমার বাবাকে আগন্তুকদের একজন সান্ত্বনা দিয়ে বলে, বিচলিত হওয়ার কিছু নেই, আপনার ছেলের পরিচয় নিশ্চিত করেই তিনি ফিরে আসবেন। এ কথা বলে আমার ভাইকে তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।

বিজয় অর্জনের পর আমি প্রায় প্রতিদিন রায়েরবাজারের বধ্যভূমি থেকে শুরু করে ঢাকার আশপাশের প্রায় প্রতিটি বধ্যভূমিতে আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজেছি। লাশ খুঁজতে গিয়ে অনেক অর্ধগলিত লাশ টেনে সরাতে হয়েছে। তখন অনেক লাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা আর আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাইনি। আমার ভাইকে আলবদররা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমার বাবা যে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন, তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তিনি ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেছেন।’

কী অবর্ণনীয় বীভৎসতা! অসহায় স্বজনদের সামনে থেকে একজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বধ্যভূমিতে গিয়ে তার লাশ খুঁজতে হয়েছে। লাশ পাওয়া যায়নি। বর্বর ঘটনাটি শহীদের বাবাকেও ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। মাত্র ৯ মাসের সন্তান অভি বাবার স্নেহ-আদর পাননি। বাবাকে কোনোদিন বাবা বলে ডাকতে পারেননি। এই করুণ চিত্র যে কারও হৃদয়কে করবে বেদনাক্রান্ত। নাড়া দেবে বিশ্ব বিবেক ও মানবতাকেও। তারপরও এই শহীদের পরিবার শত প্রতিকূলতায় সামনে এগিয়ে গেছে। এই অনির্বাণ মোস্তফা অভি যখন বাবা হারানোর কথা ব্যক্ত করতে ট্রাইব্যুনালে আসেন, তখন তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক।

সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আহমেদের অপহরণ ও হত্যা মামলায় তার ছেলে সাফকাত নিজাম সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে সাফকাত নিজাম ওরফে বাপ্পী ছিলেন চার বছরের শিশু। তিনি বড় হয়ে তার মা, নানা, নানি, মামা ও খালার কাছ থেকে তার বাবার অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পারেন। এই পরিবারেরও কষ্ট পরিমাপের কোনো সুযোগ নেই। শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দীনের লাশটি তারা খুঁজে পাননি।

শহীদের সন্তান সাফকাত নিজাম এই ট্রাইব্যুনালে বেদনাবৃত যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ :’১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর কারফিউ ছিল। দুপুর আনুমানিক ১টা থেকে ২টার মধ্যে বাসার সবাই দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। এই সময় এক পর্যায়ে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। দরজা খোলা মাত্রই আমাদের বাসায় দু’জন অস্ত্রধারী প্রবেশ করে। তারা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে আমার বাবার নাম ধরে খোঁজ করতে থাকে। আমার বাবা পরিবারের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি নিজেই খাবার টেবিল থেকে উঠে অস্ত্রধারীদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমিই নিজাম উদ্দীন আহমেদ। তার পরিচয় নিশ্চিত হবার জন্য অস্ত্রধারীরা তার কাছে পরিচয়পত্র চায়। তিনি এক পর্যায়ে পরিচয়পত্র দেখান। তখন অস্ত্রধারীরা কালবিলম্ব না করে তাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে থাকে। আমার মা তখন আমার বাবার পিছু পিছু যাচ্ছিলেন, তখন অস্ত্রধারীরা মাকে পেছনে আসতে মানা করেন।

পরবর্তীকালে আমরা আমাদের এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারি, তাকে একটি কাদামাখা মিনিবাসে করে তার চোখ এবং হাত বেঁধে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এই সময় ওই গাড়িতে পেছন দিকে হাত বাঁধা এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও অনেক ব্যক্তি ছিলেন।’

প্রগতিশীল মুক্তবাক একজন মানুষ ছিলেন শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আহমেদ। স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের ঠিক ক’দিন আগেই নির্মমতার শিকার হন তিনি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চলমান বর্বরতা অসীম সাহসে তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে। এটিই কি ছিল তার অপরাধ? কী নির্মমভাবে আক্রমণ ও হত্যা করা হয় তাকে! অসহায় স্বজনদের সামনে থেকেই তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এসবই উঠে এসেছে শহীদের সন্তান এই সাক্ষীর বেদনাবৃত উচ্চারণ থেকে। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয় তিনি দেখে যেতে পারেননি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখতে পাই-‘খুনে রাঙা সোনার বাংলায় স্বাধীনতার সূর্য দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়নি সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আহমেদ তাদের অন্যতম। জনাব আহমেদকে ১২ ডিসেম্বর বিকেল ২টায় কুখ্যাত আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। গেস্টাপো আলবদর, আলশামস বাহিনীর কলঙ্কিত বধ্যভূমি ও সম্ভাব্য স্থানে খোঁজ করেও তার কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি।

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের অপহরণ ও হত্যা মামলায় তার ছেলে সুমন জাহিদ এই মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। এই অভিযোগটি প্রমাণের জন্য রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে ফিরে আসা একমাত্র মানুষ দেলোয়ার হোসেনও সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে সুমন জাহিদের বয়স ছিল আট বছর। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ শহীদ সেলিনা পারভীনের পরিবারের সদস্যরা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার লাশ শনাক্ত করেন এবং তা উত্তোলন করে আজিমপুর কবরস্থানে সমাধিস্থ করেন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ বুকে একরাশ কান্না নিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেন-“১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ৮ বছর। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আনুমানিক দুপুরে আমি এবং আমার এক মামা (উজির) দুপুরের গোসল সেরে বাসার ছাদে অবস্থান করছিলাম। সে সময় মা রান্না করছিলেন। আমরা বুঝতে পারলাম, বাসার সামনে কিছু গাড়ি এসে থেমেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাসায় কড়া নাড়াবার আওয়াজ পাই। মা তখন দরজা খুলে দেন, তারা তখন মার পরিচয় জানতে চায়। এ সময় আমি মায়ের কাছে গিয়ে তার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আগন্তুকরা আমার মাকে বলে, আপনাকে আমাদের সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটে যেতে হবে। এই সময় মা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন যে, ‘সুমন তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিও, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব।’ এটাই ছিল আমার মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা। তখন আগন্তুকরা মায়ের হাতে থাকা একটি গামছা দিয়ে মায়ের চোখ বেঁধে ফেলে এবং ওদের হাতে থাকা মাফলার জাতীয় একটি জিনিস দিয়ে মাকে পিঠ মোড়া করে বাঁধে। এই অবস্থায় আগন্তুকরা আমার মাকে কাদামাখা গাড়িটিতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। আমরা তার আর কোনো খবর পাইনি।

এরপর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে শহীদ মুনীর চৌধুরী ও কবীর চৌধুরীর ভাই শমসের চৌধুরীর কাছ থেকে আমার মেজো মামা এবং উজির মামা জানতে পারেন, রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আমার মায়ের লাশ পড়ে আছে। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সেই লাশ সেখান থেকে উজির মামা এবং মহসিন মামা শনাক্ত করে তা উত্তোলন করে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের পাশে দাফন করেন।”

এই সাক্ষীর সাক্ষ্যে যে নির্মম সত্য উঠে এসেছে তা হলো, একজন নারী যিনি মাতৃজাতির একজন, তাকেও বর্বররা রেহাই দেয়নি। শিশুপুত্র অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখেছে তার মাকে বেঁধে নিয়ে যেতে। ক’দিন পর সেই অসহায় শিশুর মায়ের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া যায়। কী নির্মমতা! ট্রাইব্যুনাল রায়ে পর্যবেক্ষণ দেন যে, এটি কেবল সেলিনা পারভীনকে হত্যা ছিল না, এটি ছিল মাতৃজাতি হত্যা যা ‘ম্যাট্রিসাইড’। মানব বিবেককে এটি আঘাত করেছে। আজ এই নির্মম সত্যটি সবাই জানুন।

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!