Monday , December 2 2024
You are here: Home / Uncategorized / ভারতের নাগরিকত্ব বিল এবং বাংলাদেশে বিপদ

ভারতের নাগরিকত্ব বিল এবং বাংলাদেশে বিপদ

ইনাম আহমদ চৌধুরী

ভারতের লোকসভায় যে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল সোমবার ‘মধ্যরাতে’ পাস হলো, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, বিলটির পক্ষে ভোট পড়ে ৩১১ আর বিপক্ষ ভোট মাত্র ৮০। বস্তুত আমরা ভারতকে যে চোখে দেখে এসেছি কিংবা ভারতের সংবিধানে যে ধর্মীয় বহুত্ববাদের কথা বলা হয়েছে, এ বিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ জন্যই আমরা দেখেছি, বিলটি ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হওয়ার আগে সাত ঘণ্টা বিতর্ক হয়েছে। লোকসভায় যারা বিরোধিতা করেছেন, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, তারা সংখ্যায় কম হলেও বলিষ্ঠভাবেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

ভারতের সংবিধানের ১৪নং ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। সংবিধানের ধারা তো বটেই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ভারতের দর্শন তার কবিতায় এনেছেন সেটিও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে- ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান।/ এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান।/এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।’ এখানে আমাদের বিরোধিতার মূল জায়গাটা হলো ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ও বৈষম্য। পৃথিবীতে খুব কম দেশই রয়েছে, যারা ধর্মভিত্তিক। আমার জানামতে, কেবল এক ইসরায়েল ছাড়া কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত নয়। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন বিলে যে ধর্ম পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন বিলে আমাদের উদ্বেগের জায়গাটি হলো- একেবারে নাম ধরে বাংলাদেশের কথা বলা আছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কথাও বলা হয়েছে। ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশিদের যে আশ্রয় দিয়েছে, সেটি ধর্মের কারণে নয়। আমাদের জাতীয়তা ও দেশ রক্ষার্থে আমরা তখন ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তার চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের মানুষ ও সরকার অসাম্প্রদায়িক। আমরা একাত্তরে বরং ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র অস্বীকার করে স্বাধীন হয়েছিলাম। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

এখানে অন্তত এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন সরকার অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ ও নীতি বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চল্লিশের দশকে কিংবা ষাটের দশকে কী হয়েছে, তার ভিত্তিতে বর্তমান বাংলাদেশকে বিচার করলে কিন্তু হবে না। ভারতের লোকসভায় সংখ্যাতাত্ত্বিক যে হিসাবটা হাজির করা হয়েছে, সেটিও ঠিক নয়। বাংলাদেশে কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। বরং ভারতে দাঙ্গা হয়েছে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক শক্তি নির্মূলে সফলভাবে সক্ষম হয়েছেন।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন বিলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অধিকাংশই এই বিলের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। তার মানে আসাম, পশ্চিমবঙ্গে এর প্রয়োগ হবে। আমরা এ বিল নিয়ে আগে থেকেই প্রতিবাদ দেখে এসেছি। সেখানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম, মণিপুর ও ত্রিপুরায় ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। আসাম রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সংস্থাগুলো ১২ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকেছে। কলকাতায় বিক্ষোভ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, নাগরিক সংশোধনী বিল এনআরসিরই অন্য পিঠ।

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অমিত শাহ এ বিল উত্থাপন করেন। তিনি শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীর কথা বলেছেন। তিনি যদি কেবল অনুপ্রবেশকারী বলতেন, সেটা ছিল ভিন্ন বিষয়। প্রত্যেক দেশই অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে চায়। সেটা ভারত করলে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে সেখানে আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু আমরা দেখছি, এখানে ধর্মটাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিলের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতেই ভারতের সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যদিও অমিত শাহ দাবি করেছেন, সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়নি; কিন্তু তার এ দাবি আসলে সঠিক নয়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ ভারতের যেসব নেতা আলোচ্য নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের মতামত আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতা শশী থারুর বলেছেন, ‘সব ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হলে তা মেনে নেব। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়া হলে তার বিরোধিতা করব। এ বিল একেবারেই অসাংবিধানিক।’ লোকসভায় কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এ বিলের পুরোপুরি বিরোধিতা করব। কেননা, এ বিলের মাধ্যমে আমাদের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি লঙ্ঘিত হবে।’ কংগ্রেসদলীয় এমপি গৌরব গগৈ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় গণতান্ত্রিক জোটের দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিজেপির সঙ্গে না গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু নেতৃত্বের মধ্যে অল ইন্ডিয়া-মজলিশ-এ-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিন নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, ভারতীয় নাগরিকত্ব বিল এনে আরও একবার দেশভাগ হতে চলেছে। অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা বদরুদ্দিন আজমল, আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্যও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

বস্তুতপক্ষে, নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়তে বাধ্য। আমরা দেখছি, ভারত থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই অনুপ্রবেশ করছেন। এনআরসি আতঙ্কে বহিস্কারের ভয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে দলে দলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ অনুপ্রবেশকারী সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক হয়েছে। বাংলাদেশে যেভাবে অনুপ্রবেশ হচ্ছে, সেভাবে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে হচ্ছে না। তাই এই বিলকে আমরা কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে নিতে পারি না।

আমাদের কাছে বিস্ময় এ জন্য যে, ভারতের বিজেপি তো অন্তত বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবহিত। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। এমনকি আমরা যখন একটি অসাম্প্রদায়িক উপমহাদেশ চাইছি, তখন ভারতের এ ধরনের পদক্ষেপ বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে আমি মনে করি। আমরা দেখেছি, ভারতে অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে নানা স্থাপনার নাম পরিবর্তন হয়েছে। যেমন ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের মুসলিম নাম পরিবর্তন করে প্রেয়াগরাজ রাখা হয়েছে। অবশ্য আমরা এগুলোকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই দেখছি।

ভারত যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বের করতে চায়, সেখানে বাংলাদেশের কোনো সহযোগিতা চাইলে তারা সহযোগিতা পাবে। কিন্তু এ বিলের দ্বারা ধর্মের ভিত্তিতে যখন বিভক্তি ও বিভাজন করা হবে, সেটি আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। এমনিতেই বাংলাদেশ তার শ্রেষ্ঠতম সময় পার করছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দেশের একটি সংকট বাংলাদেশকেও সংকটে ঠেলে দেবে। যদিও তারা বলছেন, বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন্তু তারপরও যখন এখানে ধর্মের বিষয় আসছে, তখন আমরা স্বস্তিবোধ করব না। অনুপ্রবেশের বিষয়টি ধর্মের ভিত্তিতে কেন হবে? তারা অন্য কোনো বিষয় বিবেচনায় এনে অনুপ্রবেশ সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

বাংলাদেশের উদ্বেগ এখানেই যে, বিলটি আলোচনার সময় বারবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এসেছে। আমরা মনে করি, তা ঠিক নয়। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে আমাদের ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা মনে করি, ভারত রাষ্ট্রের মূল আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাংলাদেশও লালন করে। ভারতের মূল আদর্শ তো মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি। সে নীতিতে কালিমা লেপন হয় এমন কোনো কাজ করা ভারতের ঠিক হবে না। আমি মনে করি, ভারতের বোধোদয় হবে। ধর্মের বিষয়টি এলেই কিন্তু জাতিভেদ ও বিভাজন শুরু হবে। বৈষম্য শুরু হবে। ইতোমধ্যে আমরা নানা বিভেদও সেখানে লক্ষ্য করেছি। ভারতের যেসব নেতা বিষয়টি বুঝতে পেরে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই।

লোকসভার পর এখন এ বিল রাজ্যসভায় যাবে। ২৪৫ সদস্যের রাজ্যসভায় বিলটি পাসের জন্য ১২৩ ভোট লাগবে। বাংলাদেশ থেকে আমরা চাই, সেটি পাস না হোক। বিলটি পাস হলে এর ক্ষতিকর প্রভাব ভারতে কেবল নয়, বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় পড়বে। এক অর্থে গোটা বিশ্ব এর শিকার হবে।

সাবেক সচিব; আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!