পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল সিলেটের তারাপুর চা বাগানে গণহত্যা চালায়। এতে শহীদ হন চা বাগানের ৩৯ শ্রমিক। এই শহীদ পরিবারগুলোকে নিজস্ব জমি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে চা বাগান কর্তৃপক্ষ। সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয় দিবসে তিন শহীদ পরিবারকে জমি দানপত্রের দলিল আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে গত বছরের ১৮ এপ্রিল চা বাগান গণহত্যা দিবসে ২০ শহীদ পারিবারের কাছে জমির দানপত্র হস্তান্তর করা হয়। পর্যায়ক্রমে সকল শহীদ পরিবারকে জমির মালিকানা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত ডা. পঙ্কজ কুমার গুপ্ত।
সোমবার শহীদ শ্রমিকদের পরিবারের কাছে জমির দানপত্রের দলিল হস্তান্তর করেন দেবোত্তোর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগানের সেবায়েত ডা. পঙ্কজ কুমার গুপ্ত। যিনি নিজেও শহীদ পরিবারের সন্তান। তারাপুর চা বাগানের গণহত্যার দিনে পংকজ গুপ্তের বাবাসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। শহীদ হন চা বাগানের চিকিৎসকসহ কয়েকজন স্টাফও।
চা বাগানের শ্রমিকরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। কয়েক প্রজন্ম ধরে বাগানে বসবাস করলেও জমির মালিকানা নেই তাদের। এ অবস্থায় তারাপুর চা বাগানের শহীদ শ্রমিক পরিবারগুলোকে জমির মালাকানা প্রদানের উদ্যোগ নেয় বাগান কর্তৃপক্ষ।
সিলেটের তারাপুর চা বাগান দেবোত্তর সম্পত্তি। হাজার কোটি টাকার এই সম্পত্তি দীর্ঘদিন জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে রেখেছিলেন বহুল আলোচিত শিল্পপতি রাগীব আলী। ২০১৬ সালে আদালতের নির্দেশে বাগানটি সেবায়েত পংকজ গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং জালিয়াতির দায়ে রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইসহ পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত। এরপর থেকেই পঙ্কজ গুপ্ত এই বাগানের দায়িত্বে রয়েছেন।
সোমবার তারাপুর চা-বাগানের শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তিন শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জমি দানপত্রের দলিল হস্তান্তর করা হয়।
শহীদ লুবিয়া ঘাটয়ারের একমাত্র উত্তরাধিকারী ভাতিজা নাথুরাম, শহীদ চুরী কড়ামুদির একমাত্র উত্তরাধিকারী বোন নির্মলা কড়ামুদি ও শহীদ সুরেন্দ্র ভূমিজের একমাত্র নাতনি প্রতিমা ভূমিজ জমির দানপত্রের দলিল গ্রহণ করেন।
এ সময় তারাপুর চা বাগানের বর্তমান সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত বলেন, আমি নিজেও শহীদ পরিবারের সন্তান। আমার বাবা, কাকা, ভাইদের ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। বয়সের কারণে সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। এই গণহত্যায় শহীদ চা শ্রমিকদের পরিবার এমনিতেই অসহায়। তাই তারা যেন স্থায়ীভাবে বাসস্থানের জায়গা পায় সে ব্যবস্থা করেছি। এর আগে ২০টি শহীদ পরিবারের সদস্যদের জমির দানপত্র করে দিয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় আজ আরও তিনজনকে জায়গার দানপত্র দেয়া হল। পর্যায়ক্রমে সকল শহীদের পরিবারকে তাদের জমির দানপত্র করে দেয়া হবে।
তিনি বলেন, এর চেয়ে বেশি কিছু দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি মনে করি এই অসহায় মানুষগুলো জন্য কিছু করলে আমার পূর্বপুরুষদের আত্মা শান্তি পাবে।
এর আগে বিজয় দিবস উপলক্ষে চা বাগানের স্মৃতিস্তম্ভ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বাগান কর্তৃপক্ষ, শহীদ পরিবারের সদস্য, চা-বাগানের পঞ্চায়েত কমিটি, যুবসংঘসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের মানুষজন। প্রথমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে চা-শ্রমিক ও শহীদ পরিবারের শিশু কিশোররা। গণহত্যায় শহীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সংস্কৃতিকর্মী রজত কান্তি গুপ্তের পরিচালনায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত। মুক্তিযোদ্ধা সুকেশ চন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। এছাড়ারও চা শ্রমিক ও শহীদ পরিবারের সন্তানরা দেশাত্মবোধক গান, নৃত্য, আবৃত্তি ও মুক্তিযুদ্ধের নাটিকা পরিবেশন করেন।
উপস্থিত ছিলেন তারাপুর চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক বিজয় কান্তি দে, তারাপুর পঞ্চায়েতের সভাপতি চৈতন্য মুদি, তারাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিপা দেব, সহকারী প্রধান শিক্ষক রুবনা রায়, তারাপুর যুব সংঘের সভাপতি জগন্নাথ রায় রাজন, টিলা ক্লার্ক মজিবুর রেজা, জহির আহমেদ চৌধুরী, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোরঞ্জন রায় সমর, শহীদ ডাক্তার ক্ষিতীশ চন্দ্র দের ছেলে অসিত বরণ দে প্রমুখ।