সাজ্জাদ হোসেন
১.
বিশ্বব্যাপী নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ যেন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। উন্নত থেকে তৃতীয় বিশ্বের সবখানে হানা দিয়েছে করোনার ভয়াল থাবা। এর আগেও যুগে যুগে মহামারী এসেছে। প্রাণ গেছে লাখো কোটি মানুষের। কিন্তু করোনার মতো এমন সাম্যের নীতি নিয়ে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌছাতে পারেনি এর কোনটি।
এর অন্যতম কারণ তথ্য যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতি৷ তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিশ্বকে একটি গ্লোবাল ভিলেজ বলা হয়ে থাকে। এর যথার্থ কারণ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের সাথে সাথে মানুষ পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌছে গেছে৷
আগেকার দিনে অল্প সংখ্যক মানুষ বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা কিংবা চাকরির সুযোগ পেতো। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির বিস্তারের ফলে বিশ্বের সম্ভবত এমন কোনো দেশ নেই যেখানে প্রায় সব দেশের নাগরিক চাকরি, পড়াশোনা, গবেষণা কিংবা ভ্রমণের জন্য আসেনা। ফলে মানুষের দ্বারা ছড়িয়ে পড়া রোগ সহজেই দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তির বিস্তারের ফলে সহজেই দূর দেশের ভাইরাসের কথা দেশে বসেই জানতে পারছি রাতারাতি। ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক, আবার বাড়ছে সচেতনতাও।
করোনা ( সার্স, মার্স ইত্যাদি) আমাদের দেশের রোগ নয় এটা সকলের জানা। এমনকি এটা ভারতীয় উপমহাদেশের রোগও নয়। চীনের উহান প্রদেশে উৎপত্তি হওয়া এবং ইউরোপ – আমেরিকায় বিস্তার লাভ করা এ ভাইরাস দেশে এসেছে চীন কিংবা ইউরোপ প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাধ্যমে। চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইতালি সহ ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রসহ আমেরিকায় আমাদের দেশের কয়েক লাখ মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে বসবাস করে। করোনা ভাইরাস হানা দেওয়ায় সেসব দেশ থেকে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্য থেকে কিছু মানুষ বহন করে এনেছেন কোভিড-১৯ ভাইরাস।
২.
বিশ্বব্যাপী তথ্য প্রযুক্তির বিস্তারের কারণেই আবার আমরা করোনা ভাইরাসের গতি প্রকৃতি বিষয়ে জানতে পেরেছি। পেয়েছি আন্তর্জাতিক অনলাইন পত্রিকা, জার্নাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজারো টিপস। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত টিপস হচ্ছে ” Stay Home ” বা গৃহে থাকুন। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে কেন গৃহে থাকব? কতদিন থাকব? গৃহে থাকলেই কি রক্ষা হবে? চলে যাবে ভাইরাস? এবার আসুন গৃহে কেন থাকব, কতদিন থাকব এসব প্রশ্নের কিছু উত্তর খোঁজা যাক।
প্রথমেই যে প্রশ্ন আসছে কেন গৃহে থাকব?
এর উত্তর খুব সহজ। করোনা একটি সংক্রামক ব্যাধি। মানুষের থেকে মানুষে এটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই আপনি যদি বাহিরে যান এবং আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে আসেন তাহলে সহজেই আক্রান্ত হতে পারেন। আর আপনি যদি আক্রান্ত হয়ে থাকেন আর বাইরে বের হন, তাহলে আপনার কমিউনিটির ( এলাকার) অনেকের মাঝে সংক্রামিত করতে পারেন। তাই গৃহে থাকাটা খুব জরুরি।
গৃহে থাকলেই কী রক্ষা হবে?
উত্তর না গৃহে থাকলেই যে রক্ষা পাওয়া যাবে করোনার হাত থেকে এমন কথা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনা। কারণ ভাইরাস এতই ক্ষুদ্র জিনিস এবং এটার বাহক যেহেতু মানুষ তাই আপনি যতই দূরে থাকুন না কেন ভাইরাস আপনার কাছে পৌছাতে পারে।
যেমন বাজার থেকে কেনা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিংবা শাক সবজি কিংবা মাছ মাংসের ডিম দুধের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তা ছাড়া আপনি যতই গৃহে থাকুন আপনাকে এই সময়ে কোনো না কোনো মানুষের সংস্পর্শে কিংবা মানুষের স্পর্শ করা বস্তুতে আপনার স্পর্শ করতেই হবে। আপনি হয়তো হাত ধুয়ে ৯৯% জীবানু ধ্বংস করছেন কিন্তু ১% জীবানু আপনাকে আক্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট।
তাহলে গৃহে থাকলে ভাইরাস চলে যাবে?
না গৃহে থাকলে ভাইরাস চলে যাবেনা। ভাইরাস একটি নির্দিষ্ট সময় পর চলে যেতে পারে। সেটা আপনার গৃহে থাকার উপর নির্ভর করবেনা। বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এ ভাইরাস চলে যাবে। আবার এর বিপক্ষে অনেক মতও রয়েছে। তবে একটা জিনিস সর্বজন স্বীকৃত, ভাইরাসের প্রতি মানুষের সহনশীলতা এবং ভাইরাসের বিপক্ষে কোনোভাবে মানুষের শরীর প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হলে এটি পালাবে। কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রয়োগ শুরু হলে ভাইরাস বিদায় নিবে মানুষের কাছ থেকে।
তাহলে কতদিন এভাবে কাজকর্ম বন্ধ রেখে গৃহে বন্দী থাকব?
এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে উত্তরে আমি বলব না, আমাদের অনন্তকাল ঘরে বসে থাকতে হবেনা। এমনকি ভাইরাস দেশ থেকে চলে না গেলেও আমরা খুব বেশিদিন গৃহে বন্দী থাকব না। দেশে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জনিত সংক্রামক বহু রোগ এখনো আছে। যেমন- যক্ষা, ইয়েলো ফিভার, জন্ডিস, রেবিস, ইনফ্লেুায়েঞ্জা, মাম্পস, হাম, বসন্ত, হার্পিস, রোটাভাইরাস ডায়ারিয়া, এনথ্রাক্স, মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, এনডিডলেটেড বিভার, হুপিংকাশি, গনোরিয়া, কলেরা আরো কত কি। কিন্তু এসবের ভয়ে আমরা ঘরে বন্দী থাকি? থাকিনা। কারণ এসব থেকে রক্ষার জন্য টিকা, ঔষধ, পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, ডাক্তার, স্পেশালাইজড হসপিটাল তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি যেটা তৈরি হয়েছে সেটা ভয়কে জয় করার সক্ষমতা। কিন্তু নতুন বর্ণচোরা গোলকধাঁধাপূর্ণ এ ভাইরাসটির টিকা, ঔষধ, পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, ডাক্তার, স্পেশালাইজড হসপিটাল সেভাবে এখনো গড়ে ওঠেনি। এখনো আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করলেই দেখতে পাই পিপিই সংকট প্রকট, হসপিটালগুলোতে ভয়ে ডাক্তার নার্সরা সর্দি কাশির রোগীর কাছে পর্যন্ত যেতে ভয় পাচ্ছেন। সর্দি কাশি নিয়ে কোথাও কোথাও আবার গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছেনা, ট্রাক থেকে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কবর দিতে দেওয়া হচ্ছেনা, স্বজনরা পর্যন্ত ভয়ে রোগীকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন। কিট সংকটের কারণে, পিসিআর মেশিন, পরীক্ষাগার পরিচালনায় দক্ষ টেকনিশিয়ান কিংবা নমুনা সংগ্রহের জন্য দক্ষ জনবলের অভাবে সকল উপসর্গ বহনকারী ব্যক্তিকে পরীক্ষা করাতে পারছেনা সরকার। আবার সর্দি কাশি নিয়ে বিভিন্ন যায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ, ফলে বাড়ছে আতঙ্ক।
কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন চলবেনা, চলতে পারেনা। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি সরকারের নিকট লাখের কাছাকাছি কিটের মজুদের খবর। এ ছাড়া আজ ( ৩১ মার্চ) পর্যন্ত নতুন ৯ টি পরীক্ষাগার চালু করা হয়েছে যেখানে পরীক্ষা ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে। আরো ২৮ টি ল্যাব সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে, আগামি সপ্তাহে সেগুলোতে পরীক্ষা করানো যাবে। পর্যাপ্ত পিপিই সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সংগ্রহ করেছে সরকার। সরকারি বেশ কিছু হসপিটালকে করোনার জন্য স্পেশালাইজড করা হয়েছে। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০০০ শয্যার হসপিটাল করে দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কুইক টেস্টের কিট তৈরি করছে, আইইডিসিআর দিন রাত প্রশিক্ষণ দিয়ে টেকনিশিয়ান ও স্বাস্থ্য সহকারীদের প্রস্তুত করছেন। ধীরে ধীরে ডাক্তারদের মধ্যেও ভীতি কমতে শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়াগুলো শেষ হলেই বন্দীদশা কিছুটা কেটে যাবে বলে মনে করি।
এখনো উত্তর পেলেন না তো ঠিক কবে মুক্তি পাওয়া যাবে তাইতো?
আপাতত সরকার একটা মেসেজ দিয়ে রেখেছে। চলমান সাধারণ ছুটি ও অঘোষিত লকডাউন আগামি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। তার মানে ১১ এপ্রিলের মধ্যে একটি বিশেষ পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি সেরে ফেলবেন বলেই ধারণা করা যায়।
তাহলে গৃহে থাকার লাভটা কী হচ্ছে?
খুব সিম্পল, সাময়িক গৃহে থাকার ফলে ভাইরাস সংক্রমণের লাগাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে দেশ। আর এ সুযোগে প্রস্তুত হবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও হসপিটালগুলো এবং আমরাও নিজেরা করোনা মোকাবেলায় শারিরীক ও মানসিক প্রস্তুতি পর্বটা সেরে ফেলতে পারব। ইউরোপ – আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতেও করোনার আকস্মিক বিস্তারে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনের অভাবে শত শত রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। সঠিক সময়ে গৃহে থাকার কারণে আমরা তেমন খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি, এজন্য সকলেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
সর্বপরি একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে এটাই বলতে চাই শীঘ্রই এই বেদনাদায়ক বন্দীদশা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে। কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত হবে গোটা দেশ। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আগের মতো মুখরিত হবে তারুণ্যে। এবং অবশ্যই করোনার কাছে জয়ী হবে মানুষ।
এই সময়টুকুতে তাই প্লিজ গৃহেই থাকুন।
লেখক: সাংবাদিক