প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাসে চা খাচ্ছেন নাকি বিষ খাচ্ছেন শিরোনামে একটা স্বচ্ছ ডিসপোজেবল গ্লাসের ছবি প্রায়ই ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে৷ এইখানে সাবধান করা হচ্ছে এই বলে যে– এই গ্লাস তৈরীতে বিষাক্ত “বিসফেনল এ” ব্যবহার করা হচ্ছে৷ কথাটা কতটুকু সত্য? প্রথমেই জেনে নেয়া যাক প্লাস্টিকের গ্লাস কি দিয়ে তৈরী হয়? প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম ইউজেবল পানির গ্লাস তৈরী হয় লো-ডেনসিটি পলিইথিন (LDPE) বা পলিস্টাইরিন দিয়ে৷ কফি গ্লাসের জন্য সবসময় গুরুত্ব দেয়া হয় পলিস্টাইরিনের উপর৷ LDPE এর পানির গ্লাস ও পলিস্টাইরিনের কফি গ্লাস সারাবিশ্বে সমান ভাবে বহুল ব্যবহৃত গ্লাস৷ তবে উন্নয়নশীল দেশে পলিইথিলিন ট্রেফথ্যালেট (PET) দিয়েও ওয়ান টাইম ইউজেবল স্বচ্ছ গ্লাস গুলা তৈরী হয়৷ ওয়ান টাইম ইউজেবল ড্রিংকিং গ্লাস ছাড়াও ড্রিংকিং ওয়াটার সরবরাহের জন্য বাসা বাড়িতে যে পাইপ ব্যবহার করা হয় সেটাও তৈরী হয় পলিইথিলিন বা পলিইথিন প্লাস্টিক দিয়ে৷ ইথিলিন গ্যাস হচ্ছে এই পলিইথিনের মনোমার৷ পলিথিন ব্যাগ? হ্যা ঠিকই ধরেছেন! পলিব্যাগ তৈরী করা হয় যে পলিমার দিয়ে সেই পলিমার দিয়েই পানি সরবরাহের শক্ত পাইপ তৈরী করা হয়৷ তবে পলিথিন ব্যাগ তৈরী হয় লো-ডেনসিটি পলিইথিন দিয়ে এবং পানির পাইপ তৈরী হয় হাই-ডেনসিটি পলিইথিন দিয়ে৷ এই পলিইথিন দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যারেল ও তৈরী করা হয়৷ নীল রংয়ের যেই ব্যারেল গুলা তরল দুধ সরবরাহের জন্য ব্যবহার করতে দেখেন ঐ ব্যারেল গুলাও এই হাই-ডেনসিটি পলিইথিন দিয়ে তৈরী৷ তেলের ঢব বা কসমেটিক্সের ডিব্বা গুলাও তৈরী হয় পলিইথিন দিয়ে৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পলিইথিন দিয়েই মানব দেহের জন্য কৃত্রিম অস্থি তৈরী করা হয়৷ এই অস্থি তৈরির পলিইথিন কে বলা হয় আলট্রা হাই মলিকুলার ওয়েট পলিইথিন৷ পলিস্টাইরিন ও এক ধরনের পলিমার৷ স্টাইরিন মনোমার দিয়ে এই পলিস্টাইরিন তৈরি করা হয়৷ পলিস্টাইরিন গ্লাসে ঠান্ডা পানীয় পান করা যদিও নিরাপদ কিন্তু গরম পানীয় পান করা তুলনামূলক কম নিরাপদ৷ উচ্চতাপমাত্রায় স্টাইরিন বা এডিটিভস লিচিং হবার ঝুকি থাকে৷ যদিও খুবই ট্রেস এমাউন্টে৷ যেটা নেগলিজিবল হিসেবে ধরা হয়৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের Food and Drug Administration এখনও অবধি পলিস্টাইরিন খাবারের সংস্পর্শে আসা নিরাপদ মনে করছে৷ আমরা যেটাকে স্টাইরল শোলা বলি৷ টিভি, ফ্রিজ প্যাকেজিং এ যে সাদা শোলা ব্যবহার করা হয় সেটাও পলিস্টাইরিন দিয়ে তৈরী হয়৷ ওয়ান টাইম খাবারের প্যাকেট– রেস্টুরেন্ট থেকে যেগুলাতে করে খাবার প্যাক করে দেয়া হয়– ওগুলো ও পলিস্টাইরিন দিয়ে তৈরী৷ মিনারেল ওয়াটারের বোতল তৈরী হয় পলিইথিলিন ট্রেফথ্যালেট দিয়ে৷ এই বোতল কে বলা হয় পেট (PET) বোতল৷ ট্রেফথ্যালিক এসিড ও ইথিলিন গ্লাইকল মনোমার দিয়ে এই পলিমার টা তৈরী করা হয়৷ ঠান্ডা পানীয় বা তরলের ক্ষেত্রেও এই বোতল নিরাপদ৷ যদিও গরম পানীয় এই বোতলের সংস্পর্শে এলে বোতল কুচকে যায়৷ তাই এই বোতলে গরম পানীয় ব্যবহারের সুযোগ থাকেনা৷ তারপরেও কিছু এডিটিভ মিশিয়ে সংকোচনরোধক করে উন্নয়নশীল দেশে গ্লাস বানিয়ে ব্যবহার করা হয়৷ এই গ্লাসে গরম পানীয় ব্যবহার কম নিরাপদ৷ যদিও নির্ভর করে কি জাতীয় এডিটিভ পলিমারে মেশানো হচ্ছে৷ এইবার আসি “বিসফেনল এ” প্রসঙ্গে৷ এই “বিসফেনল এ” একটা মনোমার৷ যদিও প্লাস্টিসাইজার (এডিটিভ) হিসেবেও এটি ব্যবহার করা হয়৷ এই “বিসফেনল এ” মনোমার দিয়ে যে প্লাস্টিক তৈরী করা হয় তার নাম হচ্ছে পলিকার্বোনেট৷ এই পলিকার্বোনেট দিয়ে কখনোই প্লাস্টিকের গ্লাস বা কাপ তৈরী করা হয়না৷ এই প্লাস্টিকটা তুলনামূলক দামী ও খুব স্বচ্ছ৷ স্বচ্ছতার জন্য পলিকার্বোনেট দিয়ে সিডি ডিস্ক, চশমা, জানালার গ্লাস, সেফটি গগল্স, প্লাস্টিকের স্বচ্ছ শিট ইত্যাদি তৈরী করা হয়৷ আরো কিছু পরিচিত প্লাস্টিকের নাম এবং ব্যবহার বলে যাই৷ শিখে রাখেন দৈনান্দিন কাজে লাগবে৷ নর্দমার পাইপ তৈরী হয় পিভিসি পলিমার দিয়ে৷ ভিনাইল ক্লোরাইড মনোমার দিয়ে এই পলিমার তৈরী হয়৷ ট্রেস এমাউন্টে বিষাক্ত থ্যালেট প্লাস্টিসাইজার ও ফ্রি ক্লোরিন লিচিং এর ঝুকির জন্য পিভিসি পলিমার মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নয় বলেই খাদ্য জাতীয় দ্রব্যাদি থেকে পিভিসি দুরে রাখা হয়৷ পিভিসি দিয়ে পাইপ ছাড়াও দরজা জানালার পাল্লা ও চৌকাঠ তৈরী করা হয়৷ ডেকোরেটরের দোকানে যে প্লাস্টিকের আরএফএল চেয়ার গুলা দেখেন– ঐগুলাও পিভিসি পলিমারের তৈরী৷ যদিও থ্যালেট প্লাস্টিসাইজার মিশিয়ে পিভিসি প্লাস্টিক দিয়ে ফ্লোর কার্পেট, খেলনা, জুতা, কেবল ইন্সুলেটর সহ অনেক কিছুই তৈরী করা হয়ে থাকে৷ এই পিভিসিতে ট্রেস এমাউন্ট বিসফেনল এ প্লাস্টিসাইজার হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ যদিও প্লাস্টিসাইজড পিভিসি দিয়ে চায়ের কাপ বা পানির বোতল তৈরীর কোন সুযোগ নেই৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে ব্লাড ব্যাগ তৈরী হয় পিভিসি পলিমার দিয়ে৷ এই ব্লাড ব্যাগ তৈরীর পিভিসি মেডিক্যাল গ্রেডের জন্য খুব সংবেদনশীল করে তৈরী করা হয় যেখানে ক্লোরিন রিলিজের কোন সুযোগ থাকেনা৷ এছাড়া দৃঢ়তা এবং ফ্লেক্সিবিলিটির জন্য পিভিসি ছাড়া অন্য কোন পলিমার ব্লাড ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়না৷ টিফিন বক্স, প্যারাস্যুট তেলের বোতল বা ক্রিমের কৌটা তৈরী হয় পলিপ্রোপিলিন দিয়ে৷ ওভেনপ্রুফ টিফিনবক্স গুলাও পলিপ্রোপিলিন দিয়েই তৈরী হয়৷ প্রোপিলিন মনোমার দিয়ে এই পলিমার তৈরী করা হয়৷ পলিপ্রোপিলিন হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই হাই ডেনসিটি পলিইথিন এর বিকল্প ব্যবহার৷ কাজেই পলিইথিন দিয়ে যা বানানো সম্ভব তা পলিপ্রোপিলিন দিয়েও বানানো সম্ভব৷ সোফার ফোম তৈরী হয় পলিইউরাথেন পলিমার দিয়ে৷ এর মনোমার হিসেবে ব্যবহার করা হয় আইসো সায়ানেট ও পলিঅল৷ মূলত গদি জাতীয় আসবাবপত্র তৈরীতেই পলিইউরাথেন ব্যবহার করা হয়৷ এছাড়া প্যাকেজিং এ এই পলিমার ব্যবহার করা হয়৷ নাইলন দড়ি বা প্যারাসুট সুতা যেটা আমরা বলি সেটাও এক ধরনের পলিমার৷ ক্যাপ্রোল্যাকটাম মনোমার দিয়ে নাইলন দড়ি বা সুতা তৈরী করা হয়৷ আমরা যেটাকে পলেস্টারের কাপড় বলি সেটি আসলে পলিএস্টারের তৈরী কাপড়৷ এই কাপড় টিও এক রকমের সরু নাইলন জাতীয় সিথেটিক সুতা দিয়ে তৈরী কাপড়৷ এছাড়াও এডিপিক এসিড ও হেক্সামিথিলিন ডাইএমিন দিয়েও নাইলন দড়ি বা সুতা তৈরী করা হয়৷ ননস্টিক ফ্রাইপ্যানের ননস্টিক কোটিং দেয়া হয় পিটিএফই দিয়ে৷ এই পলিমার কে আবার বানিজ্যিক ভাবে টেফলন ও বলা হয়৷ এই জিনিসটা নিয়েও আজেবাজে গুজব প্রচলিত আছে৷ এই পলিমার ডিগ্রাডেট হলে ফসজিন নামের বিষাক্ত গ্যাস তৈরী হয়–এটা সত্য কথা৷ যদিও নরমাল রান্নায় টেফলন ডিগ্রাডেট করা সোজা কথা নয়৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে– এই পলিমার কখনোই মেল্ট হয়না৷ উচ্চ তাপমাত্রায় সরারসি ডিগ্রাডেট হয়ে যায়৷ এত উচ্চ তাপমাত্রা আমরা রান্না ভাজাপোড়ায় ব্যবহার ও করিনা৷ যদিও উচ্চ তাপমাত্রায় টেফলন মেল্ট হয়না বলাও ঠিক নয়৷ আসলে মেল্ট হবার পরেও এর ভিসকোসিটি এতটাই বেশি থাকে যেটা কঠিন পদার্থের মতই আচরণ করে৷ যদিও বাসা বাড়িতে দেখা যায়– দিনের পর দিন ফ্রাইপ্যান ব্যবহারের ফলে ননস্টিক কোটিং উঠে যায়৷ এটা আসলে আমাদের অজ্ঞতার কারনেই উঠে যায়৷ ননস্টিকি প্যানের জন্য সবসময় কাঠের খুন্তি বা ননস্টিকি খুন্তি ব্যবহার করতে হয়৷ স্টেইনলেস স্টিলের খুন্তির ক্রমাগত ঘষাঘষির ফলেই টেফলন কোটিং উঠে যায়৷ ফ্রাইপ্যান পরিস্কার করার সময় মেটাল স্ক্রাবার ব্যবহারের ফলেও টেফলন কোটিং উঠে যায়৷ এই কোটিং পলিমার অবস্থায় থাকতেই উঠে যায়৷ এর মানে এই নয় যে বিষাক্ত ফসজিন গ্যাস হয়ে গেলো৷ একমাত্র ভালোমত বার্ন করা ছাড়া টেফলন সহজে ডিগ্রাডেট হয় না৷ চশমার লেন্স তৈরী হয় পিএমএমএ পলিমার দিয়ে৷ বানিজ্যিক ভাবে একে প্লেক্সিগ্লাস ও বলে৷ মিথাইল মিথাক্রাইলেট হচ্ছে এই প্লেক্সিগ্লাসের মনোমার৷ স্বচ্ছ কাঁচের বিকল্প হচ্ছে এই পলিমার৷ এটাকে বলা হয় সেফটি গ্লাস৷ বড় বড় স্কাই স্ক্রাপারে ভঙ্গুর ইনঅর্গানিক গ্লাস (সিলিকা কাঁচ) শিটের পরিবর্তে এই পলিমার শিট ব্যবহার করা হয়৷ যদিও অনেক ক্ষেত্রে প্লেক্সিগ্লাসের পরিবর্তে পলিকার্বোনেট পলিমার ও ব্যবহার করা যায়৷ কোন প্লাস্টিক সামগ্রী কি দিয়ে তৈরি! কিভাবে জানবেন? প্লাস্টিকের তৈরী জিনিসটির তলায় বা আশেপাশে কোনায় কানায় ত্রিভুজের মধ্যে রিসাইকেল সংখ্যা দেখে বুঝতে পারবেন এটি কোন পলিমার দিয়ে তৈরি৷ একে বলা হয় রেজিন আইডেন্টিফিকেশান কোড৷ এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটা পলিমারের রিসাইক্লিং কোডের উদাহরন দিচ্ছি৷ ত্রিভুজের মধ্যে যদি ১ লেখা দেখেন তখন বুঝবেন এটি পলিইথিলিন ট্রেফথ্যালেট (PET) দিয়ে তৈরী, যেমনঃ পেট বোতল৷ “২” থাকলে সেটি হাই-ডেনসিটি পলিইথিন, যেমনঃ পানির পাইপ, কসমেটিক্স বা ভ্যানিশিং ক্রিমের ডিব্বা৷ “৩” হচ্ছে পিভিসি, যেমনঃ নর্দমার পাইপ, জানালা দরজার পাল্লা, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি৷ “৪” লো ডেনসিটি পলিইথিন, যেমনঃ পলিব্যাগ, পানির গ্লাস ইত্যাদি৷ “৫” পলিপ্রোপিলিন, যেমনঃ কসমেটিক্স বা ক্রিমের ডিব্বা, টিভির বডি, টিফিন বক্স ইত্যাদি৷ “৬” পলিস্টাইরিন৷ যেমনঃ প্যাকেজিং শোলা, ডিসপো গ্লাস, কফি কাপ৷ যদি “৭” থাকে সেক্ষেত্রে বুঝে নিবেন এই লিস্টের বাইরের কোন পলিমার– এক্ষেত্রে সেটা হতে পারে পলিকার্বোনেট, নাইলন ইত্যাদি৷ ©Mahbub Manik
