রুমী আহমেদ খান: ঢাকা থেকে ট্রাকে করে রংপুরে ফিরছিলেন শাহ আলম। করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকায় বগুড়ার মহাস্থান এলাকায় ট্রাক থেকে ফেলে রেখে যাওয়া হয় এই ট্রাকশ্রমিককে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৬ দিন চিকিৎসার পর ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় তাঁকে। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে সোয়েল রানা
কোভিড-১৯ নিয়ে মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলের সংখ্যা এখন ৫০ হাজারের ওপর! তারপরও কোভিড-১৯ রোগটা এত নতুন ও এর উপসর্গ ও জটিলতা এত ব্যাপক, বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদি যে হিসাব মেলানো কঠিন। প্রতিদিন এত নতুন তথ্য আসছে যে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সব বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সময়মতো সাধারণ মানুষ বা সাধারণ চিকিৎসক সমাজের কাছে তুলে ধরে গিয়ে তাল মেলাতে পারছেন না!
শেষ হয়েও হয় না শেষ
কোভিড-১৯ অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা রোগটার অপ্রকাশিত বা অজানা দিকগুলো নিজেরাই চিহ্নিত করছেন এবং দলবদ্ধ হয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রোগটার নতুন মাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করে দিচ্ছেন। এর একটা বড় উদাহরণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে কোভিড-১৯-এ ভোগা কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দেখলেন যে তাঁদের সবার কোভিড-১৯ হয়ে ভালো হয়ে গেলেও প্রায় সবাই একই ধরনের দীর্ঘায়িত লক্ষণে ভুগছেন। অনেকের ফিরে ফিরে গায়ে জ্বর আসছে, অনেকের জ্বর জ্বর ভাবটা যাচ্ছে না, অনেকের গিরাব্যথাটা যাচ্ছে না। অনেকের প্রচণ্ড গা ব্যথা প্রাত্যহিক ব্যাপার হয়ে গেছে কোভিড-১৯ নেগেটিভ হয়ে যাওয়ার পরও! এই মানুষেরা নিজেদের নাম দিলেন কোভিড লং হলার (long haulers covid) এবং #LongCovid হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতা ও সহায়ক গ্রুপ তৈরি করলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগী রোগীরা এই সাপোর্ট গ্রুপের মেম্বার হওয়া শুরু করলেন এবং সদস্যসংখ্যা লাখের ওপর হয়ে গেল!
যদিও প্রথমে এই ব্যাপারটা নিয়ে রোগীরাই কথা বলা শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে চিকিৎসকেরাও ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন যখন প্রথম ধাক্কার রোগীরা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বা হাসপাতালে না গিয়ে নেগেটিভ হওয়ার পরও মাস, দুই মাস, তিন মাস ধরে চলা সিম্পটম নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে ফিরে আসা শুরু করলেন এবং অতি সম্প্রতি এ অভিজ্ঞতাগুলো চিকিৎসকেরা বিশ্লেষণ করে শেয়ার করা শুরু করেছেন।
যেসব উপসর্গ রয়ে যায়
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি কয়েক সপ্তাহ আগে একটা জরিপের ফল প্রকাশ করেছে যে ৩৫ শতাংশ রোগী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার দু-তিন সপ্তাহ পর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সিম্পটমে ভুগতে থাকেন। অতি সম্প্রতি ইতালি থেকে আসা একটা গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮৭ শতাংশ কোভিড-১৯ রোগীর অন্তত একটা উপসর্গ থেকে যায় মাসের পর মাস।
যেসব উপসর্গ ক্রনিক হয়ে যায় তার মধ্যে কমন হচ্ছে দুর্বলতা, ক্লান্তি আর শ্বাসকষ্ট। কোভিড-১৯ রোগীরা ভালো হয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি উপসর্গের কথা বারবার বলছেন। একটা বড় উপসর্গ হচ্ছে ব্রেইন ফগ—সারাক্ষণ মাথা ঝিম ঝিম করা, মাথা ধরে থাকা, কোনো কাজে মনোনিবেশ করার অক্ষমতা বা মাথাব্যথা করা। অনেকের একেবারে নতুন করে রাতে নিদ্রাহীনতা হচ্ছে। অনেকে পিটিএসডির মতো দুঃস্বপ্ন দেখছেন। অনেকে আবার সারা দিন খালি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন।
কারও কারও কিছু কিছু বিষয়ে স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে। অনেকের বলা নেই, কওয়া নেই মাথার চুল পড়া শুরু করেছে। অনেকের চামড়ায় দাগ-জ্বালা বা র্যাশ হচ্ছে, বিশেষ করে শরীরে নিচের অংশে। জ্বর ও জয়েন্ট পেইন বা গায়ে ব্যথার কথা তো আগে বলেছি।
অনেকের মধ্যেই স্ট্রোক করার বা রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কোভিড-১৯ থেকে ভালো হয়ে যাওয়ার পর।
বুকে ব্যথা বা বুকে অস্বস্তি অনেক কোভিড-১৯ থেকে ভালো হয়ে যাওয়া রোগীর একটা নিত্যনৈমিত্তিক অভিযোগ।
শ্বাস বা ফুসফুস-সংকান্ত ক্রনিক সিম্পটম বিভিন্ন ধরনের। একটা হচ্ছে শুকনো কাশি। ভাইরাস ভালো হয়ে গেছে কিন্তু শুকনো কাশি যাচ্ছে না। কাশতে কাশতে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম! এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। অন্য ভাইরাল সংক্রমণে আমরা এটা আগে দেখেছি—এখন কোভিড-১৯-এ দেখছি। লাং ফাইব্রোসিস থেকে শ্বাসকষ্ট আর অক্সিজেনের অভাব বাকি জীবনের জন্য রয়ে যেতে পারে অনেকের ক্ষেত্রে। অনেকের আবার দেখছি, কোভিড-১৯ ভালো হয়ে যাওয়ার পরও লো গ্রেড ফুসফুসের ক্রনিক প্রদাহ রয়ে গেছে।
গন্ধ শোঁকার ক্ষমতা চলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরুতেই হয়। কিন্তু এ সমস্যাটা কোভিড-১৯ ভালো হয়ে যাওয়ার পরও অনেকের রয়ে যাচ্ছে। অনেকেই জিবে স্বাদ পাচ্ছেন না একেবারেই।
শিশু, বালক-বালিকাদের বেলায়ও দেখা যাচ্ছে, ওদেরও ক্রনিক প্রদাহজনিত কিছু বিরল অসুখ হচ্ছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের ফলে।
এগুলো কেন হচ্ছে
এগুলো কীভাবে চিকিৎসা করব, সে ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণসহ বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো আমাদের হাতে নেই। তবে পূর্ববর্তী কিছু ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রভাবগুলো গবেষণা করে আমরা কোভিড-১৯-এর সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাই।
কোভিড-১৯-এর জ্ঞাতিভাই সার্স বা মার্সের বেলাতেও মাঝেমধ্যে একই ব্যাপার দেখেছি। যেমন দেখেছি স্মল পক্স, চিকেন পক্স, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের ক্ষেত্রেও। ভাইরাসটা আমাদের শরীরকে আক্রমণ করে একপর্যায়ে আমাদের ডিফেন্স সিস্টেম বা ইমিউন সিস্টেমের কাছে হার মেনে শরীর থেকে বিদায় নেয়। ভাইরাস ভালো হয়ে যায়, শরীর ভাইরাসমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে প্রদাহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। এই প্রদাহটা ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে অনেক দিন ধরে। এই প্রদাহগুলোই হয়তো ওপরে বর্ণিত অনেক উপসর্গের কারণ।
আমি কীভাবে চিকিৎসা করছি এই উপসর্গগুলোর? চিকিৎসা করতে হবে কি না, তা নির্ভর করবে উপসর্গের ওপর এবং আক্রান্ত অর্গানের ওপর। অনেক ক্ষেত্রে হালকা জ্বর চলতে থাকলে বা ফুসফুসের সিটি স্ক্যান প্রদাহ সাজেস্ট করলে আমি খুব লো ডোজ স্টেরয়েড দিয়ে চেষ্টা করি। বাংলাদেশে দেখছি এই রোগীগুলোকে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। এই প্রদাহের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না, বরং ব্যাপক হারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের আশঙ্কা তৈরি হয়|
নতুন করে জ্ঞান ঝালিয়ে নিতে হচ্ছে
একটা কথা আমাদের সবার, বিশেষ করে আমার চিকিৎসক বন্ধুদের বোঝা খুব দরকার যে ৫০ হাজার পেপার প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগটা সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞান ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে—ভাইরাস রোগ নিয়েও অনেক কিছুই জানে। আমাদের বেসিক সায়েন্সের বইগুলোয় প্রদাহ, বিশেষ ভাইরাস-পরবর্তী প্রদাহ নিয়ে ব্যাপক পরিমাণ জ্ঞান সঞ্চিত আছে। আমরা কোভিড-১৯-এর অনেক চিকিৎসাই করতে পারি ভাইরাস ও মানবদেহে ভাইরাসের সংক্রমণের জ্ঞান দিয়ে। চিকিৎসক বন্ধুদের আবার বলি, আপনি যদি সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি চ্যানেল ও পত্রপত্রিকায় নিজেকে কোভিড-১৯ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিয়ে জনস্বাস্থ্যে অবদান রাখতে চান তা খুব ভালো কথা, কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য নিজের প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ আর অভিজ্ঞতা অর্জন খুব জরুরি। কোভিড-১৯ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে, একে বুঝতে হলে আমাকে ভাইরাস বুঝতে হবে, ভাইরোলজি বুঝতে হবে, বেসিক প্যাথলজি ও ফিজিওলজি আবার পড়তে হবে ও বুঝতে হবে। জ্ঞানার্জনের কোনো শেষ নেই, সময়-অসময় নেই।
রুমী আহমেদ খান: বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত এবং ট্রেনিং প্রোগ্রামের পরিচালক। মেডিসিনের (রেসপিরেটরি ও আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক।