Sunday , April 20 2025
You are here: Home / মতামত / করোনা আর ব্যতিক্রমী ভাবনা !
করোনা আর ব্যতিক্রমী ভাবনা !

করোনা আর ব্যতিক্রমী ভাবনা !

সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম

 

 

৮ মাস ধরে করোনা আতঙ্ক, অতি পরিচিত, সহকর্মী প্রিয়জনদের মৃত্যু-সংবাদ আমাদের বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ৮ মাস ধরে সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা তৈরি হয়েছে, যে ভাবনার সাথে অন্য কারও মিল না থাকলেও আমি আমার ভাবনা থেকে একটুও সরে আসতে চাই না।

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে এ ধরনের অস্পষ্ট ধারণা ছাড়া তেমন কোনো স্পষ্ট বোধগম্য তথ্য এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

যেমন- ভাইরাসটি কোনো একটা প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়াতে ছড়াতে আবার নিজের জিনগত গঠনে সবসময় পরিবর্তন আনছে। যাকে বলে মিউটেশন।

তাই এ ভাইরাস হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে।

কিন্তু এ ভাইরাসটির প্রকৃতি এবং কীভাবেই বা তা রোধ করা যেতে পারে- এ সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা বিশদভাবে জানার চেষ্টা করছেন।

সার্স বা ইবোলার মতো নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদমাধ্যমে আসে। এই করোনাভাইরাস তার মধ্যে সর্বশেষ।

কিন্তু এটি কি ‘আজ আছে কাল নেই’ ধরনের কোনো ভাইরাস? নাকি এটা তার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক?

করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি।

ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরনের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতিমধ্যেই ‘মিউটেট করছে’ অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে, যার ফলে এটি আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ।

এক দশক আগে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরনের করোনা ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি লোক।

এই মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে আমার সবসময় মনে হয়ে আসছে – এটি সারা বিশ্বের মানব জাতির ওপর মহান আল্লাহ্‌র তরফ হতে অভিশাপ বা গজব! আর এই অভিশাপ বা গজব আবির্ভূত হয়েছে যুগ যুগ ধরে জীবনযাপন পদ্ধতি সঠিকভাবে মেনে না চলার জন্য! আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় (হয়তো আমার ভুলও হতে পারে) যে করোনাভাইরাস নামের এই ফ্লু আমাদের একদম অচেনা নয় (মেডিকেল সাইন্স নিঃসন্দেহে এই বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারবে) এবং এর থেকে নিরাময়ের বিধিনিষেধও আমাদের একদম অজানা নয়। সারা বিশ্বে এর ব্যাপকতার (মহামারি আকার) জন্য এই ভাইরাসকে আমাদের একদম অচেনা, অজ্ঞাত কিছু মনে হচ্ছে কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এই ভাইরাস আমাদের সাথে সাথেই ছিল তবে দুর্বল সহাবস্থানের কারণে আমরা হয়তো এর গুরুত্ব বা ভয়াবহতা বুঝেতে পারিনি! পূর্বে বিচ্ছিন্নভাবে অল্প সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে বা সুস্থ্ হয়েছে যার জন্য আমরা হয়তো এর অবস্থানকে সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি বা গুরুত্ব দেইনি, কিন্তু এবার এই ভাইরাস মহামারি আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ায় আমরা এর ভয়াবহতা সহজে বুঝতে পেরেছি। আমার ব্যক্তিগত ধারণাতে বা বিশ্বাসে এই ভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে যুগ যুগ ধরে মানুষের অসচেতন জীবন পদ্ধতির কারণে!

সঠিক জীবন পদ্ধতি কি সেটি আমরা জানি- আমরা আমাদের নিজ নিজ ধর্ম থেকে জানি, মহামানবদের উপদেশ থেকে জানি, মনীষীদের মহামূল্যবান বাণী থেকে জানি, গুরুজন, বিজ্ঞজনদের পরামর্শ হতে জানি কিন্তু আমরা বাস্তবে কেউই সঠিকভাবে মেনে চলি না ।

সারা বিশ্বের তথ্য অনুযায়ী তুলনামূলকভাবে এই ভাইরাসে বয়স্ক এবং পুরুষ আক্রান্তের এবং মৃত্যুর প্রবণতা বেশি! মহান আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে না বললেই চলে। মহিলারা তুলনামূলক ভাবে কম আক্রান্ত হচ্ছে বা যে কোনো কারণে সংক্রমিত হলেও সুস্থ হয়ে উঠার প্রবণতা বেশি! দরিদ্র বা অতি সাধারণ মানুষের সংক্রমণের হারও খুবই নগণ্য বা নেই বললেই চলে। এর থেকেও কেন জানি মনে হয় সঠিক জীবন পদ্ধতিতে আমাদের কোথায় যেন ভুল হচ্ছে !

যেহেতু আমি এখানে আমার মতামত পেশ করতে চাইছি সুতরাং আমি আমার কিছু অভিজ্ঞতা দিয়েই আমার বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দিতে চাইছি।

আমার জন্মের পর হতে সামান্য অসতর্কতাতেই আমি কয়েকটি কারণে যেমন- ধুলা, আলো-বাতাসহীন নোংরা বদ্ধকক্ষ, অল্প জায়গাতে অতিরিক্ত মানুষের ভিড়, সুতি ছাড়া যেকোনো সিনথেটিক পোশাক, অতিরিক্ত গরম, অতিরিক্ত ঠান্ডা ইত্যাদি কারণে এক ধরনের এলার্জিতে আক্রান্ত হতাম যার ফলে নাক চুলকানো বা নাক দিয়ে পানি পড়া, গলা ব্যথা, হাল্কা জ্বর, শ্বাসকষ্ট, অরুচি ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতাম। তবে এই সমস্যাগুলো আমার জন্মের পর খুব ছোট বেলাতে বেশি ভুগেছি, একটু বড় হয়ে যখন সাবধানতা বুঝতে শিখেছি (দাদি, মা বুঝিয়েছেন) তখন এই সমস্যা থেকে ভালো থেকেছি, সুস্থ থেকেছি এবং ধীরে ধীরে ‘এলার্জির’ বিষয়টি প্রায় ভুলেই গিয়েছি, কারণ আমি একটি নিয়মের মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে চলতে শিখেছি তখন।নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করেছি আমার নিয়মমাফিক। কিন্তু আমার বিয়ের পর আবার বিপত্তি শুরু হয়। কারণ তখন আমাকে আমার অভ্যস্ত নিয়মের বাইরে অন্যরকম পরিবেশ আর পরিস্থিতির নিয়মের নিয়ন্ত্রণে চলতে হয়েছে ।

আমি জন্ম থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত একটি মহকুমা শহরে (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) বড় হয়েছি। উঠান ঘেরা বাড়ি, সামনে বিশাল সরকারি খোলা মাঠ, দিঘির মতো বিশাল সরকারি পুকুর আর একটু সামনেই রাস্তার গা ঘেঁসেই বিশাল মধুমতী নদী। চারদিকে খোলামেলা বুকভরে শ্বাস নেওয়ার মতো দূষণমুক্ত পরিবেশ।

স্বামী ঢাকা সিএমএম আদালতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট।বিয়ের পর ঢাকায় সংসারজীবন শুরু, ঝিগাতলা ভাড়া ফ্ল্যাট বাসা, বদ্ধ পরিবেশ, বেশির ভাগ সময় একা আবদ্ধ জীবন! বিভিন্ন জায়গাতে দাওয়াত, অনুষ্ঠান, সুতি পরছি না সিনথেটিক দেখার বা বোঝার উপায় নেই, সময় নেই। লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া। সহপাঠী সবাই মিলে দলবলে ধুলা বা ভিড়ের মধ্যে থাকা- সম্পূর্ণ নিয়মের বাইরের জীবন শুরু। ফলে এলার্জিজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে যাই মাঝে মাঝেই- সেই অসুস্থতা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার মতোই অসুস্থতা- হাল্কা জ্বর, গলা ব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়া, মাথা ব্যথা, অরুচি, কাশি অবশেষে শ্বাসকষ্ট। এ সময় এমনকি ওষুধের সাথে সাথে মাঝে মাঝে আমাকে ‘ইনহেলার’ও ব্যবহার করতে হতো- বয়স কম, প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাই ভালো হয়ে উঠে সব ভুলে যেতাম বা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সব ভুলতে বাধ্য হতাম। এর মধ্যে আমার স্বামী ‘মহকুমা প্রশাসক’ হিসেবে ঢাকার বাইরে বদলি হন, এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পরপর দুবার ঢাকার বাইরে বদলি হন। ঢাকার বাইরে খোলামেলা পরিবেশে আমি তুলনামূলকভাবে বেশি সুস্থ বোধ করতাম। তবে ১৯৮৫ সালে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে খুলনা বিভাগের রূপসা উপজেলায় বদলি হন। সেখানে গিয়েই আমি আবার ঘন ঘন এলার্জিতে ভুগতে থাকি। এবার সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এসে আমার বোঝার পরিপক্বতা বেশি হওয়ায় আমি নিজে ডাক্তারের সাথে কথা বলে আমার সমস্যার কথাগুলো ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলি। সেবার কষ্টের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে ইনহেলারেও আমি শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিলো আমি শ্বাসকষ্টে মরে যাবো যেকোনো সময়! আমি ডাক্তারকে সব কিছু বুঝিয়ে বলার পর উনি আমাকে এলার্জির ওষুধ (সম্ভবত হিস্টাসিন) ছাড়াও ভিটামিন “C” এবং AD capsule সহ কিছু নিয়ম মেনে চলতে বললেন। সে নিয়মগুলো ছিল –

১। কোনো ড্যাম্প বা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে অবস্থান না করতে। (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাড়িটি পুরানো আর স্যাঁতসেঁতে ছিল পরে সেটিকে নতুন করে ওয়াস এবং রং করে নেওয়া হয় )

২। যতদূর সম্ভব ঘরের দরজা-জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে (সে সময় নিরাপত্তা আর privacy বিবেচনায় সরকারি বাসার কাঠের পুরোনো জানালাগুলো সবসময় বন্ধ করে রাখা হতো।)

৩। ঘরে রুমজোড়া কার্পেট ব্যবহার না করা। দিনের পর দিন রুমজোড়া কার্পেট থেকে এক ধরনের ভাইরাস তৈরি হয় যা এই ধরনের এলার্জিজনিত অসুখ তৈরিতে সাহায্য করে । (আমি বাসা থেকে ফ্লোর খালি করে সব সরকারি কার্পেট তুলে ফেলি এবং ভবিষ্যতে কোনো দিন এমনকি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং জেলা প্রশাসক হিসেবে ১০ বছর ঢাকার বাইরে সরকারি বাসাতে অবস্থানকালেও আমি সরকারি বাসাতে রুমজোড়া সরকারি কার্পেট বিছাতে দেইনি ।)

৪। খুব ভোরের সূর্যের আলো গায়ে মাখা ।

৫। সকাল থেকে বেলা ১টার মধ্যে গোসল করে নেওয়া এবং প্রতিদিনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেছে নেওয়া ।

৬।পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং তরল জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া যেমন যেকোন ধরনের স্যুপ (মুরগি ছাড়াও পেঁয়াজ, সবজি বা রাইস স্যুপ।)

৭। খাবারের তালিকায় যে পদ্ধতিতেই হোক রসুন আর কালোজিরা মেথি যেন থাকে ।

৮। প্রতি সপ্তাহে ৩-৪ বার করে বিছানার চাদর পরিবর্তন করা ।

৯। প্রতিদিন দুইবার করে ঘর মুছিয়ে নেওয়া এবং ঘর মোছাতে লিকুইড ক্লিনার যেমন ডেটল, স্যাভলন বা অন্য যেকোনো লিকুইড ক্লিনার ব্যবহার করা ।

১০। অজুর মতো করে দিনে কয়েকবার হাত-মুখ-পা ধুয়ে ফেলা এবং নিয়মিত নামাজ পড়লে প্রতিবার অজু করা।

১১। দরজা-জানালার পর্দা প্রতি সপ্তাহে পরিবর্তন করা। ক্লিনার দিয়ে নিয়মিত আসবাবপত্র পরিষ্কার করা।

১২। বাসার চারদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, রোদ মাখা ঝরঝরে রাখা !

১৩। বিকালে খোলা বাতাসে হাঁটাহাঁটি করা এবং সম্ভব হলে ব্যাডমিন্টন জাতীয় খেলায় অংশ নেওয়া (ঢাকার বাইরে আমাদের সরকারি বাসায় মহিলাদের ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ।)

১৪। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা। আনন্দময় হাসিখুশি পরিবেশে থাকা ।

১৫। সামাজিক জীবনযাপন করা ।

১৬। সুতি কাপড় পরিধান করা ।

১৭। কাঁচাবাজার জাতীয় স্থানে গেলে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করা।

১৮। বাসায় আলমিরাতে কাপড় গোছানোর সময় এবং ঘর গোছানোর সময় মাস্ক ব্যবহার করা (আমি সব সময় সেটা মেনে চলে আসছি ১৯৮৫ সাল থেকে।)

১৯। পুরোনো ফাইল বা দরকারী কোনো পুরোনো ডকুমেন্ট নাড়াচাড়ার দরকার পড়লে সেগুলো ডেটল, স্যাভলন বা যেকোনো ক্লিনার মাখানো পরিষ্কার রুমাল বা টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করে মুছে নেওয়া ।

২০। আদা , লবঙ্গ , তেজপাতা দিয়ে হাল্কা রং চা দিনে অন্তত একবার করে প্রতিদিন।

এসব ১৯৮৫ সালের কথা। আর পরামর্শগুলো দিয়েছিলেন ঢাকার বাইরে খুলনা বিভাগে একজন অভিজ্ঞ, বয়োবৃদ্ধ ডাক্তার। হয়তো আমারও বয়সের কারণে ঠিক এই মুহূর্তে তার নাম মনে করতে পারছি না। তবে তার কথাগুলো/পরামর্শগুলো সব মনে রেখেছি এবং মেনে চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর এর সাথে দীর্ঘদিন ধরে নিজের অভিজ্ঞতাও যুক্ত করেছি। যেমন-নিয়মিত প্রতিদিন খাদ্যতালিকাতে বা ব্যবহারে নিমপাতা , তুলসী পাতা, কাঁচা করলার সালাদ, এলোভেরা, পাথরকুচি, পাঁচপাপড়ির লাল রক্ত জবা, খেজুর, বিভিন্ন ধরনের বাদাম , শিমের বীজ , সূর্যমুখীর বীজ, কুমড়ার বীজ ইত্যাদি যুক্ত হয়েছে।

উনি আমকে বলেছিলেন যে আমি যদি একদম নিয়মিত কঠোরভাবে এসব মেনে চলি তাহলে আমি সারা জীবনের জন্য সুস্থ্ থাকবো। মহান আল্লাহর ইচ্ছাতে নিয়মগুলোর প্রতিটি কঠোরভাবে মেনে চলে আমি ১৯৮৫ সাল থেকে বর্তমান ২০২০ সাল পর্যন্ত এলার্জিমুক্ত আছি, সুস্থ আছি। ১৯৮৫ সালের সেই সতর্ক পরামর্শগুলো ২০২০ সালের করনাকালীন সতর্ক পরামর্শের সাথে কোথায় জানি অনেকখানি মিলে যায় !

প্রাণঘাতী করোনার একটি ঢেউ পার করেছি সুস্থভাবে, জানি না সামনের ঢেউ সামলাতে পারব কি না !

করোনাভাইরাসের লক্ষণ, ভয়াবহতা এবং এর প্রতিকার-পদ্ধতি কোনোটাই কেন জানি না শুরু থেকে আমার নতুন কিছু মনে হয়নি ! যেমন-

১৯৮৮ সালে আমি ঢাকায় একটি সুপ্রতিষ্ঠিত জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে হেড অফিসে এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। চাকরির এক বছরের মধ্যে আমি সিনিয়র অফিসার হিসেবে বিমা দাবি নিষ্পত্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হই । বিমা দাবি নিষ্পত্তির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বিভিন্ন ডকুমেন্ট আর ইনস্যুরেন্স ল’ এর ওপর নির্ভরশীল। আমাকে প্রচুর পড়াশোনা ছাড়াও প্রচুর ডকুমেন্ট এবং ফাইল ঘাঁটতে হতো প্রতিদিন।তবে আমি এক মুহূর্তও সেই ডাক্তারের পরামর্শগুলো ভুলে যেতাম না। আমার সাথে আমার সিনিয়র ম্যানেজার ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন তিনি , আমাকে কন্যার মতো স্নেহ করতেন। তার চেয়ারের পেছনের ওয়ালে মাথার ওপর ছিল বিশাল এক এসি, চেয়ারের পেছনে দেয়াল ছিল কিছুটা ড্যাম্প বা স্যাঁতসেঁতে ( আমার তাই মনে হতো ।) বয়সের কারণেই হোক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক তিনি খুব প্রয়োজন ছাড়া চেয়ার থেকে উঠতেন না। প্রয়োজনীয় ফাইল, ডকুমেন্টগুলো তিনি তার টেবিলের ওপর আর পায়ের কাছে দিনের পর দিন জমা করে রাখতেন। নড়াচড়া করতে চান না বলে সেগুলো ক্যাবিনেট বা আলমিরাতে তুলে রাখতেন না। পায়ের কাছে ফাইলগুলোর পাশেই তিনি তার ব্যবহারের ছোট ডাস্টবিনটি রেখে দিতেন । তার ঘন ঘন ঠান্ডা, কাশি লেগেই থাকতো। বয়োবৃদ্ধ তিনি, একটুতেই ঠান্ডা লেগে যেত, পায়ের কাছে রাখা ডাস্টবিনটিতে কফ, থুথু ফেলতেন,সম্ভবত এক বছরের মধ্যে তিনি ভয়ানক ঠান্ডা এবং নিউমুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হন! ২-১ দিনের মধ্যে তার অবস্থার ভয়ানক অবনতি ঘটে। তাকে ICU তে স্থানান্তরিত করা হয়।অক্সিজেন চলা অবস্থাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোথায় জানি করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সাথে সেই মৃত্যু মিলে যায়।

আমার নিজস্ব ভাবনাতে মনে হয় ভাইরাসগুলো হয়তো তখন দুর্বলভাবে বিচ্ছিন্ন কাউকে কাউকে আক্রান্ত করতো। এর ব্যাপকতা না থাকায় মানুষ সতর্কতার বিষয় নিয়ে গুরুত্বের চিন্তা মাথাতেও হয়তো আনেনি । তখন এটা বিচ্ছিন্ন কিছু বয়স্কদের অসুখ হিসেবে গুরুত্বহীন ছিল। বিশ্বব্যাপী যুগ যুগ ধরে এই ভাইরাস হয়তো শক্তি অর্জন করেছে, ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে,অবশেষে মহামারির রূপ ধারণ করেছে। তবে পরস্পরবিরোধী একটি অবাক করা বিষয়- এই অসুখ গরিব, দিনমজুর, কৃষক, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা তাদের আক্রান্ত করছে না । আক্রান্ত বা মৃত্যুবরণ করছেন সমাজের বিশিষ্টজন! অবাক করার বিষয় নিঃসন্দেহে।

মার্চ ২০২০ এর শেষের দিকে, সম্ভবত ২৪ মার্চ হতে বাংলাদেশে ‘লকডাউন’শুরু হয় । ২৪ মার্চ ২০২০ হতে এখন পর্যন্ত আমি একটি দিনের জন্যও গৃহবন্দি থাকিনি বা আমাকে কেউ গৃহবন্দি রাখতে পারেনি। প্রতিদিনের বাজার, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা আমি নিজে করে আসছি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিকে সবার ধারণা ছিল এই ভাইরাস হয়তো দরিদ্র, নিম্ন শ্রেণির সাধারণ জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হবে, এই মহামারিতে তারাই আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরন করবে ব্যাপক হারে! বিষয়টি বোঝার জন্য আমি স্বেচ্ছায় অতি সাধারণ মানুষের সাথে মিশে দেখেছি তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস ভীতি তেমন প্রবল না যতটা প্রবল ধনী বা উচ্চ শ্রেণির মধ্যে।

তাদের মধ্যে এই ভাইরাসের গুরুত্ব বা ভয়াবহতা কিছুই তেমন কাজ করতে দেখিনি । পুরোপুরি লকডাউনের মধ্যেও তাদের দেখেছি পরিবার নিয়ে বাইরে রোদের ভিতর ঘোরাঘুরি করছে। তবে তাদেরও একটি জীবন পদ্ধতি আছে, হয়তো সেটিই সঠিক পদ্ধতি। আমাদের বাসার দারোয়ান সপরিবারে আমার বাসায় অবস্থান করে আসছে ১০ বছরেরও অধিক সময় ধরে। এদেরকে দেখেছি সপরিবারে গেটের সামনে রোদে বসে আছে । তাদের কাঁথা বালিশ এমনকি খাট পর্যন্ত কয়েকবার করে রোদে তাতিয়ে নিয়েছে । যেকোনোভাবেই হোক তাদের সাথে প্রাকৃতিক ভটামিন ‘ডি’-এর সাথে সখ্য, প্রকৃতির সাথে সখ্য। হয়তো প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা এই সাধারণ মানুষকে হয়তো প্রকৃতিই এই মহামারি থেকে রক্ষা করে রেখেছে !

আমি এত বড় করে ১৯৮৫ সালের ডাক্তারের পরামর্শগুলো এই কারণে উল্লেখ করেছি যে এগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ পরামর্শগুলো পালন করতে হলে সংসারে মহিলাদের সহযোগিতার প্রয়োজন পড়বে। পরিবারে তিনি মাতা হন, স্ত্রী হন, কন্যা হন বা পুত্রবধূ হন না কেন জীবনে ভালো থাকার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য তাদের সহযোগিতা অপরিহার্য। পরিবারে মহিলাদের কাজকে অপরিহার্য আর সম্মানের সাথে দেখতে হবে, সংসারে তাদের প্রতিটি কাজের অবদানের স্বীকৃতি তাদের প্রাপ্য সম্মান। তাদের সাথে সহজ স্বাভাবিক, সুমধুর আচরণ করা সবার জন্য মঙ্গলজনক ।

নিজ গৃহে বিশিষ্টজন হয়ে না, ক্ষমতাধর হয়ে না, লৌহ কঠিন ব্যক্তিত্ব নিয়ে না, উগ্রতা নিয়ে না, বিজ্ঞতায় অহমিকাবাদী হয়ে না, গোঁড়ামি , একগুঁয়ে আচরণ নিয়ে না, অনেক বেশি আমিত্ব ভাব নিয়ে না, অনিয়ন্ত্রিত হয়ে না বরং নিজ গৃহে, নিজ পরিবারে একজন অতি সাধারণ হয়ে সুমধুর পারিবারিক আনন্দঘন বন্ধনে তাদের একান্ত আপনজন হয়ে, তাদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে, ছায়া হয়ে তাদের মাঝে, সবার মাঝে, সাধারণের মাঝে, মাটি আর প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে সাধারণ জীবনযাপন করা হয়তো একান্ত প্রয়োজন এবং সেটিই হয়তো সঠিক জীবন পদ্ধতি।

করোনাকালীন বিপর্যয়ের মধ্যে আমার অন্যতম সহায় হচ্ছে আমাদের দারোয়ান আর তার পরিবার। এরা দিন-রাত আমাকে পরম আত্মীয়র মতো সঙ্গ দিয়ে আসছে। আপন আত্মীয়রা যেখানে মৃত্যু ভয়ে কাউ কারও সাথে সশরীরে সাক্ষাৎ করতে সাহস করেনি, সেখানে এই সাধারণ মানুষরা ছায়ার মতো সঙ্গ দিয়েছে । এদের একান্ত সান্নিধ্যে একাকিত্ব কি, আত্মীয়বিহীন জীবন কি এক মুহূর্তের মধ্যেও বুঝতে পারিনি। কোনো একদিন আমার স্বামী আতঙ্কিত হয়ে প্রায় চিৎকার করতে করতে বাসার বারান্দা থেকে ছুটে এসে আমাকে মহাবিরক্তের সাথে সতর্ক করতে থাকে যে দারোয়ানের পরিবারের কেউ যেন বাসায় না আসে কারণ নিজ চোখে বারান্দা থেকে দেখে আসলেন যে দারোয়ানের ছেলেমেয়েরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি মন দিয়ে তার আতংকিত চেয়ারা দেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলি খুব বেশি চিন্তা করো না, যেকোনো সময় দারোয়ানই তার বাচ্চাদের হয়তো সতর্ক করে দিবে যে এই বাসার কাছেও যেন না আসে। কারণ করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে বিশিষ্টজনদেরই সংক্রমিত করছে !

আমার এই ভাবনা শুধুই আমার ভাবনা, আমার ভাবনা আমার পরিবারের জন্য, আমার স্বামী, পুত্রের জন্য, বয়স্ক বিশিষ্টজনের জন্য, কারণ এই করোনাভাইরাসে বয়স্ক বিশিষ্টজনের আক্রান্ত আর মৃত্যুহার বেশি। কোনো বিশেষ শ্রেণিকে ছোট করার জন্য কথাগুলো আমি লিখছি না , কারণ আমি নিজেও বিশিষ্টজনের স্ত্রী ও মাতা, আমি চাই তাঁরা বেঁচে থাকুন দীর্ঘদিন পরিবারের ছায়া হয়ে, সমাজের, রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে। এভাবে নিঃসঙ্গ মৃত্যু নয় বরং মৃত্যু হোক আপনজনের কোলে মাথা রেখে।

সামনের দিনগুলো সবার জন্য নিরাপদ হোক । করোনার দ্বিতীয় ঢেউটি যেন আমাদের আপনজনদের, আমাদের কাউকে স্পর্শ করতে না পারে মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা।

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!