মো. আবু নাঈম, পঞ্চগড় : দেশের সর্ব উত্তরের কৃষি সমৃদ্ধ জেলা পঞ্চগড়। এখানকার এক বিরাট অংশ এখনো কৃষি কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে যান্ত্রিক এই যুগে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় বিলুপ্ত প্রায় পুরনো ঐতিহ্য। একসময় এ অঞ্চলের কৃষকের জমি চাষের প্রধান উপকরণ ছিলো গরু। লাঙল-জোয়াল, মই আর জোড়া গরু দিয়েই জমি উর্বর করতেন তারা।
যান্ত্রিক যুগে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারে হারিয়ে গেছে সনাতন পদ্ধতির এই চাষাবাদ। এই জনপদের মানুষদের ঘুম ভাঙত লাঙল-জোয়াল আর হালের গরুর মুখ দেখে। এখন যন্ত্রের আধিপত্যে মানুষদের ঘুম ভাঙে ট্রাক্টরের শব্দে। লাঙল-জোয়ালের জায়গা দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক পাওয়ার টিলার আর ট্রাক্টর।
তবে এই অত্যাধুনিক যুগেও পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জঙলপাড়া গ্রামের মাঠে চোখে পড়ে লাঙল-গরু দিয়ে হালচাষ করার চিত্র। ওই গ্রামের হালুয়া আবুল হোসেন এখনো বিঘা প্রতি ৩০০ টাকা দরে কৃষকের জমি চাষ করেন। চলতি মৌসুমে স্থানীয় কৃষকদের প্রায় ৭০ বিঘা জমি চাষ করেছেন তিনি।
হালুয়া আবুল হোসেনের সাথে কথা বলে মনে হলো ‘চাষী খেতে চালাইছে হাল, তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল, বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার, তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙক্তিটি বাঙালির জীবনে আবার ফিরে এসেছে।
আবুল হোসেন বলেন, ‘এক সময় হাল চাষ করেই সংসার চালাতাম। এখন ট্রাক্টর আর পাওয়ার টিলার দিয়ে মানুষ জমি চাষ করান। তবে যেসব জমিতে পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর যেতে পারেনা সেগুলোতে লাঙল-গরু দিয়ে চাষ করতে হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘গরু দিয়ে প্রতিদিন চার-পাঁচ বিঘা জমি চাষ করা যায়। গরুর লাঙ্গল দিয়ে চাষকৃত জমিতে ঘাস কম হয়। কারণ, লাঙল মাটির গভীরে গিয়ে মাটি তুলে উল্টিয়ে রাখে। উপরের মাটি নিচে পড়ে আর নিচের মাটি উপরে। এছাড়া হাল চাষের সময় গরুর গোবর জমিতেই পড়ে এতে একদিকে যেমন জমিতে জৈব সারের চাহিদা পূরণ হয় তেমনি ফসলও ভালো হয়। এজন্য অনেকেই পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করার পরও লাঙল দিয়ে জমি চাষ করান।’
এক সময় গ্রামে গ্রামে ছিলো পেশাদার হালুয়া। ভোর হতেই তারা লাঙল-জোয়াল আর গরু নিয়ে বেরিয়ে যেতেন মাঠের দিকে, জমিতে হালচাষ করতেন। দুই গরুর ঘাড়ে জোয়াল, মাঝখানে দিতেন লাঙ্গলের লম্বা ইঁশ। একই ভাবে জমি সমান করতে ব্যবহৃত হতো মই। মইয়ের সঙ্গে ইঁশের পরিবর্তে জোয়ালের দুই পাশে দুটি লম্বা রশি লাগাতেন। হালুয়ার ইশারায় চলতো গরুগুলো।
পঞ্চগড় সদর উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সেলিম কবির বলেন, ‘লাঙলের হাল দিয়ে জমি চাষে অনেক সময় ব্যয় হয়। অথচ বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে কৃষকেরা অল্প সময়ে অনায়াসে জমি চাষ করতে পারেন। এজন্যই বিলুপ্ত প্রায় হালুয়ার লাঙল-জোয়াল।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওসমান গণি রাসেল বলেন, ‘এক সময়ের কৃষকের সঙ্গী লাঙল-জোয়াল ও মই সময়ের বিবর্তনে হয়তো জাদুঘরে স্থান পাবে। আর পরবর্তী প্রজন্ম সেগুলো দেখে বাংলার কৃষির ঐতিহ্য জানবে।’