রহমান মুফিজ : মোটাদাগে দুই মতাদর্শিক বলয় থেকে মোদির বাংলাদেশ আগমনের বিরোধিতা হয়েছে। একটা বামপন্থী প্রগতিশীল বলয় আরেকটা সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল বলয়। এর বাইরে আরেকটা বলয় আছে, যারা উপরোক্ত দুই বলয়ের প্রতিবাদের শক্তির দিকে তাকিয়ে ছিল। মোদির বিরোধিতা তাদের আদর্শগত বা রাজনৈতিক কর্তব্য নয়। তবে মোদিবিরোধী যে কোনো প্রভাববিস্তারি শক্তির আন্দোলনকে পুঁজি করে সেই শক্তিকে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সমর্থন বা আস্কারা দিয়ে স্ব স্ব রাজনৈতিক ফায়দা লোটার পাঁয়তারা করছিল। কারণ এরা দুইদিকেই থাকে। ধর্মেও থাকে জিরাফেও থাকে। মোদিকে একজন সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত, ফ্যাসিস্ট, গণহত্যাকারী এবং ভারতীয় আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদের প্রতিভূ আখ্যা দিয়ে বামপন্থী বলয়টা মাঠে ছিল প্রথম থেকেই। তাদের বক্তব্য ছিল- বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মোদির মতো সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিস্টকে আমন্ত্রণ করা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার অমর্যাদা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মানের সামিল। এ বলয়টা মিছিল-সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছে। অনেক কর্মী রক্তাক্ত হয়েছে। পুলিশ আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল, যারা মোদির আগমনের বিরোধিতা করবে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে বিবেচনা করা হবে আর হেব্বি ক্যালানো হবে। বামপন্থী ছেলেমেয়ারা ওইসব হুমকীকে পরোয়া করেনি।
অপরদিকে পুলিশের বক্তব্যের পর হেফাজতে ইসলাম নামের সাম্প্রদায়িক, উগ্র ধর্মান্ধ সংগঠন ও তাদের বলয় থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল মোদির আগমনের বিরুদ্ধে তারা কোনো কর্মসূচি দেবে না। এ বলয় থেকে যারা কোনো ঘোষণা দেয়নি তারা অনেকেই কৌশলে নিরব ছিল। সম্ভবত তারা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। আর অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছিল যে, হেফাজত যা বলেছে, তারা ঠিক সে অবস্থানে থাকবে না। হেফাজতের মধ্যকার বিভক্তি সম্পর্কে ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে কমবেশি খবর এসেছে। আওয়ামী লীগ জমি দিয়ে, বল দিয়ে, মাতৃপরিচয় দিয়েও হেফাজতকে ঠিক বশে আনতে পারেনি(এটা বলা অবশ্য ন্যায্য হলো কি না-সংশয়ে আছি, কারণ হেফাজত যা করছে তার ফল আখেরে আওয়ামী লীগের ঘরেই যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে)।
‘গুজরাটের কসাই’ সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত মোদি আসছে আর বাংলাদেশে একটা সাম্প্রদায়িক ভজকট পাকবে না, তা তো হয় না। মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে মুসলমানী জজবানি না তুললে ওই পারে মোদিরও যেমন ইজ্জত থাকে না; ভোট বাড়ে না, তেমনি এই পারে শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়ুকরণের বটিকাও হাতছাড়া হয়। সুনামগঞ্জের শাল্লায় তাই হিন্দুপল্লীতে হামলা যেমন অনিবার্য হয়ে পড়ে তেমনি অনিবার্য হয়ে পড়ে মোদিবিরোধী মিছিলে গুলি চালানো।
বামপন্থী বলয়ের মোদিবিরোধিতা কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উদ্রেককারী নয়। কিন্তু হেফাজত ও তাদের বলয়ে মোদি বিরোধিতার মধ্যে যতটা রাজনৈতিক অভিভাষণ থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে সাম্প্রদায়িক উসকানী, শ্রেষ্টত্ববাদের উল্লম্ফন, ঘৃণা ও বিদ্বেষসৃষ্টিকারী অবস্থান। যেমনটা মোদি ও তার দল বিজেপি করে থাকে। ন্যায্যত, যে কারণে মোদি পরিত্যাজ্য সেই একই কারণে হেফাজতও পরিত্যাজ্য। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরও পরিত্যাজ্য। কারণ, সে-ও একই সাম্প্রদায়িক মগজ দিয়ে দেখছে গোটা পরিস্থিতিকে। বামপন্থীদের মোদিবিরোধী মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার পর সে বলেছে- কোনো ‘মুসলমান’ ছাত্রলীগ করতে পারে না। এখানে মসুলমানিত্বের দোহাই তুলে এ মুরুক্ষ প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষেই অবস্থান পষ্ট করেছে। সে যদি বলতো, কোনো শুভবোধসম্পন্ন ছাত্রই ছাত্রলীগ করতে পারে না, তাহলে তাকে বিনাবাক্যে সাধুবাদ জানাতাম, আর মোদিবিরোধী আন্দোলনে স্বাগত জানাতাম।
এখন মোদিবিরোধী আন্দোলনের সব বলয়কে এক করে যারা মুড়িঘন্ট পাকাচ্ছেন, তাদের অভিসন্ধি ঠিক কি, তা ঠাহর করতে কষ্ট হচ্ছে। যারা ধর্মেও থাকে আবার জিরাফেও থাকে তাদের বোঝা একটু মুশকিল। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তো ভাল মানুষ। তিনি ধর্ম ও জিরাফে একই সঙ্গে ভর করলে কষ্ট লাগে।
৯টি লাশ, ডিপ্লোমেসি ও দুই দুর্বৃত্তের ফাঁদ:
আমাদের ট্র্যাজেডি হলো-সাম্প্রদায়িক হেফাজতকে ত্যাজ্য ঘোষণা করলেও মোদিবিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে হাটহাজারি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারি বাহিনীর গুলিতে যে ৯ সন্তানের লাশ পড়লো তাদের পরিত্যাগ করতে পারছি না। প্রতিবাদে গুলির বিষয়টিও মেনে নিতে পারছি না। এভাবে মানুষ হত্যা করার কোনো অধিকার কারো নেই। একটা ফ্যাসিস্ট মতাদর্শকেও যখন কোনো ফ্যাসিস্ট সরকার বুলেটের ভাষায় দমানোর চেষ্টা করে, মানুষ হিসেবে তার প্রতিবাদ করা আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কয়েকদিন আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যক্টের বিরুদ্ধে ছাত্রদল-যুবদলের কর্মসূচিতেও যখন পুলিশ ন্যাক্কারজনক হামলা চালালো, রক্তাক্ত হতে দেখলাম প্রতিবাদকারীদের তখনও প্রায় একই অনুভূতি কাজ করেছিল। আজ একেবারে ৯ আদম সন্তানের লাশ দেখলাম। এ সন্তান কারা? খেটে খাওয়া গরীব মানুষের সন্তান। আমাদের ভাই। নানা বাস্তবতায় কুলহীন এ সন্তানদের ঠিকানা হয়েছে হেফাজত। তাদের লাশের ওপর ভর করে উগ্র সাম্প্রদায়িক এ সংগঠনের নেতারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করবে, পাওয়ার শোডাউন দেখিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দরকষাকষি করবে; লাশ বেচবে। আর সরকার বেচবে হেফাজতসহ সাম্প্রদায়িক উগ্রশক্তিকে। এ শক্তিকে টিকিয়ে রেখে, এ শক্তির সঙ্গে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক ভারতীয় সরকারের কাছে এ কৃতিত্ব জাহির করবে যে, তাকে ‘প্রচ্চুর স্ট্রাগল’ করতে হচ্ছে। এ স্ট্রাগলে তাকে জিততে হলে ভারতের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন লাগবে। মোদি তার ভারতীয় জনগণের কাছে বিক্রি করবে বাংলাদেশকে। ভারত-বাংলাদেশে উগ্র মুসলিম উল্লম্ফনকে ‘পাকপন্থী উল্লম্ফন’ দেখিয়ে হিন্দুত্ববাদী ঘৃণ্য রাজনীতির জমিনে বিপুল জলসিঞ্চনের সুযোগ নেবে।
খেয়াল করুন, এবার মোদিবিরোধিতার কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগ দিয়ে পিটিয়ে কেলিয়ে সে কেন্দ্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ মোদিবিরোধিতার কেন্দ্র যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয় তখন কায়েমী স্বার্থবাজরা সেখান থেকে খুব একটা ফায়দা তুলতে পারে না। তাই মোদিবিরোধিতার কেন্দ্র ‘বায়তুল মোকাররম’ নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না তাদের। আর বায়তুল মোকাররম যখন মোদিবিরোধিতার কেন্দ্র হয়, তখন মোদিবিরোধী আন্দোলনের আখেরাত কি হবে তা আন্দাজ করতে রকেট সায়েন্স জানা লাগে না। বায়তুল মোকাররম কেবলা হওয়ার একদিনের মাথায় লাশ পড়া শুরু হলো। এ লাশ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী, মোদিবিরোধী প্রতিবাদকে যতটা মহিমা দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি মহিমা দিচ্ছে কথিত ইসলাম রক্ষার আন্দোলন ও দক্ষিণপন্থী ভাবধারাকে। এবং সেটাকে কেউ কেউ পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে মাঠে নেমে পড়েছেন। ফলে আমার ভাইদের প্রাণবিসর্জন যতটা আমাকে কাঁদাচ্ছে ততটাই আমাকে করে তুলছে ডিপ্লোমেটিক বা কৌশলী। যেখানে রাজনৈতিক সমীকরণ পষ্ট সেখানে কান্নাটা কাঁদবেন কি কাঁদবেন না, লাশের খাটিয়া ধরবেন কি ধরবেন না, সেটার সিদ্ধান্ত নিতে হয় নানা সমীকরণ মিলিয়ে। এটাই রাজনীতি। আবেগ দিয়ে এ রাজনৈতিক ফাঁদকে মোকাবেলা করা কঠিন।
বরং আবেগ দিয়ে, হৃদয়ের সর্বোচ্চ মানবিক অভিভাষণ দিয়ে একটা দাবিই তুলতে পারেন, একটা প্রতীতিই জানাতে পারেন- ভুল রাজনীতি ও উল্লম্ফনের বলি হয়েছে যে সন্তানেরা, তার দায় নিতে হবে ক্ষমতাসীনদের। এ ক্ষমতাসীন বলয়ে আওয়ামী লীগ যেমন আছে তেমনি আছে হেফাজতও। খুব শিগিগরই আপোসরফার টেবিলে ওই লাশগুলোকে উপাদেয় নাশতা হিসেবে সরবরাহ করা হবে। সেই আপোসরফার টেবিল থেকে দুই দুর্বৃত্তকেই লাথি মেরে সরানোর তাগৎ যেদিন এদেশের মানুষ অর্জন করবে, সেদিনই প্রকৃত স্বাধীনতার জয়ন্তী উদযাপিত হবে। মনে হয় না দিনটি বেশি দূরে।
