ডা. শামীম তালুকদার:
বিশ্বজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা, বিশ্লেষণ বা গবেষণা যখন শুধু করোনা ভাইরাসকে ঘিরে তখন অন্যান্য রোগ-ব্যাধি বা সংক্রমণের ভাবনার আশঙ্কা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে গেছে। বড় দুর্যোগে ছোট-খাট প্রতিকূলতাকে যেমন কিছুই মনে হয় না তেমনি করোনাকালে অন্যান্য ছোট-খাট রোগ শোক আমাদের কাছে তেমন কোনো বিষয় না। তবে আলোচনায় না আসা ব্যাধিগুলো কিন্তু থেমে নেই। প্রিভেনটিভ রোগগুলোর বিপরীতে কিউরেটিভ রোগগুলোকে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। কেননা করোনার অতিমারীতে আমরা এতটাই বিপর্যস্ত হয়েছি যে অন্য দিকগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তার সময় আমরা পাচ্ছি না।
সুযোগটা নিচ্ছে অসংক্রামক রোগগুলো। ক্যান্সার, হাইপারটেনশন বা ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগগুলো ধীরে ধীরে তাদের রাস্তা প্রসারিত করছে। এই সকল অসংক্রামক রোগ একদিকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমনি কমিয়ে দেয় তেমনি ধীরে ধীরে একজনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। এইসকল রোগে আক্রান্ত রোগীরা সবচেয়ে জটিলতায় পড়ে যখন করোনায় আক্রান্ত হয়। সংক্রামক ও অসংক্রমক ব্যাধি মিলে একজনকে এমনজায়গায় নিয়ে যায় যে তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ হয়ে আসে। এর উপর আবার সবচেয়ে বেশি জটিলতায় পড়ে গরীব ও মধ্যবিত্তরা। কারণ অর্থাভাব, সংক্রামক ও অসংক্রামক এই তিনটি রোগেই তারা আক্রান্ত হন। ফলে যে কয়দিন বাঁচেন, অর্ধমৃত অবস্থায় বাঁচেন।
সেলিনা খাতুন। বয়স ৪২। খুবই সাধারণ ঘরের একজন গৃহীণি। পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র গৃহকর্ত্রী। ছয় বছর আগে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। আবার মাসখানেক আগে থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও প্রকট। হাইপারটেনশনও আছে। বংশে একজন ব্যক্তি মামা শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রথমে শুধু ডায়াবেটিস ধরা পড়লেও পরবর্তীতে বিভিন্ন রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকার ওষুধ লাগে। লেজিনটা, সেক্রিন, সারজেল, ভিন্টা ডি, কার্ডিজেম, ম্যাক্স-ডি, এ্যারেভেন্ট, ডিসোপ্যান সহ নানা রকমের ওষুধ খান। এর উপর আবার ঢাকা উদ্যানের একটি বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন এবং মাসিক ভাড়া টানতে হয় দশ হাজার টাকা। পরিবারের পাঁচ সদস্যের খাবার খরচতো আছেই এছাড়াও অন্যান্য খরচও কম নয়। তাঁর স্বামী পরিাবরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ঢাকা-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কর্মী। মাসিক আয় করেন ১৫-১৬ হাজার টাকা। পরিবারের উপার্জনের চেয়ে ব্যয় প্রায় দিগুণ হওয়ায় দিন দিন ঋণের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। ছোট ছেলে মেয়েকে কাজে পাঠিয়েছেন বাধ্য হয়ে। করোনায় যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে তাই সন্তানরাও কাজে যেতে না করতে পারছেন না।
চিকিৎসা, খাবার ও অন্যান্য খরচ যখন কাটিয়ে উঠতে পারেন না তখন কিস্তির ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বল্প আয়ের কারণে এ কিস্তি দুই থেকে তিন বছর ধরে টানতে হয়। আবার মাঝে যদি টাকা সংকটে পড়েন তাহলে টাকা জোগাড়ের আর কোনো পথ খোলা থাকে না। না খেয়ে থাকতে হয়। আর মাঝে মাঝে টাকার অভাবে ওষুধ বন্ধ করে দিতে হয়। সেলিনা খাতুন বলছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভোগার সাথে সাথে, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, দুর্বলতা অনুভব, শ্বাস নিতে সমস্যাসহ অন্যান্য অনেক রোগের উপসর্গ তিনি অনুভব করলে রাজধানীর সিটি হসপিটালে চিকিৎসা সেবার জন্য যান। সেখানে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এমআরআই পরীক্ষা করান। ধরা পড়ে ফুসফুস সংক্রমণ। ডায়াবেটিসের সাথে যুক্ত হয় বাড়তি রোগ, সাথে ওষুধ ও খরচ।
দৈনন্দিন কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, খাওয়া দাওয়া এখন সময়মতো করেন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খান। মিষ্টি জাতীয় ও অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাদ্য পরিহার করেন। প্রতিবেশীদের সাথে হাটতেও বের হন যদি গ্রহস্থালির কাজ করার পর সময় থাকে। তার ভাষ্যমতে, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দৈনন্দিন জীবন কাঠামো পরিবর্তন করা সত্তে¡ও ডায়াবেটিস ২৯ এর নিচে আসেনা কখনোই।
তাসলিমা আক্তার। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। পরিবারের সদস্য ছয় জন। গত বছরের মার্চ মাসে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। সাথে ভুগছেন থাইরয়েডের সমস্যায়। মাসে ওষুধ ব্যায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। স্বামী সাতমসজিদ মোহাম্মদপুরের কাছে চায়ের দোকান করেন। বাসা ভাড়া দেন প্রতি মাসে নয় হাজার টাকা। সাথে বিদুৎ, পানি ও গ্যাস বিল দিতে হয়। বড় ছেলে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতো। করোনায় লোক ছাটায়ের তালিকায় পড়ে ছেলে চাকুরি হারায়। বর্তমানে উপর্জনের একমাত্র পথ চায়ের দোকান। এই ছোট দোকান থেকে যা আয় হয় ভাড়া ও খাওয়া খরচেই তা ফুরিয়ে যায়।
খাদ্যাভ্যাসের কথা উঠলে জানা যায়, প্রচুর পরিমাণে লবন খেতে পছন্দ করেন তিনি। তবে মিষ্টি জাতীয় খাবার একদমই খেতে পারেন না। সকালে না খেয়েই কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দিনে ভাত খান একবার বা দুইবার। আর সবসময় কাজের মধ্যেই থাকেন তাই হাঁটাহাঁটিও কম হয় না। এদিকে স্বামীর কিডনি রোগে আক্রান্ত। তার অপারেশনের পর দৈনিক ওষুধ খেতে হয়। নিজে ওষুধ কিনতে না পারলেও স্ত্রীর জন্য ওষুধ কেনার চেষ্টা করেন।
ডায়াবেটিসে বিভিন্ন লক্ষণে আক্রান্ত হওয়ার পরেও তাসলিমা আক্তার প্রথমদিকে পরীক্ষা করাননি টাকার অভাবে। কিন্তু পরে যখন এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চরম মাথা ব্যাথা, শরীর দূর্বলাত নিয়ে যখন ডাক্তারের কাছে যান তখন তার ডায়াবেটিসের মাত্রা প্রায় ৩২। ‘খেয়ে, না খেয়ে দিন পার করতে হয়, তার উপর আবার ডায়াবেটিস। ওষুধ কিনি তো ভাত পাই না, আবার ভাত খাই তো ওষুধ পাই না। কিন্তু কি আর করার, সংসারের টানা পোড়েনের মধ্যেও চিকিৎসা না নিলে বেঁচে থাকতে পারবো না। টাকা না থাকলে ঋণ করি আবার কম দামি যে ওষুধ খাই’, বলছিলেন তাসলিমা আক্তার।
সেলিনা খাতুন ও তাসলিমা বেগমের মতো ফাতেমা বেগম, তানুজা খাতুন, নুুরুল ইসলাম, আমীর শিকদার সহ দেশে অনেক ডায়াবেটিস রোগী শোচনীয় অবস্থায় দিন পার করছেন। অভাব ও রোগ দুটিকেই কাঁধে করে নিয়ে পার করছেন এককেটি দিন। করোনা কালে আয় উপার্জন কমে যাওয়ায় দূর্ভোগটা যেন একটু বেশিই পোহাতে হচ্ছে তাদের। এদের মধ্যে কেউই ডায়াবেটিসের সাধারণ চিকিৎসা সম্পর্কে অবগত নয়। একই সাথে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বা সরকারিভাবে তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা কেউই জানেন না। সরকারি হাসপাতাল বলতে তারা শুধু বোঝেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আর এই হাসপাতালগুলোতে গেলে বিনামূল্যে কিছু ওষুধ পাওয়া যায়। তবে তারা এই সরকারি হাসপাতালে যান না, অনেক সিরিয়াল ধরে বসে থাকতে হয় সে ভয়ে। সরকারিভাবে ডায়াবেটিস চিকিৎসা বা ‘নিদের্শনা বই’য়ের ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা মাঝে মাঝে আসেন আর গর্ভবর্তী মায়েদের লিস্ট লেখে নিয়ে যান। ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য কোনো নির্দেশনা বা পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ আসে না। তাই তাদের বে-সরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তারদের উপর নির্ভর করেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় অনেকসময় ওষুধ কিনতে পারেন না, ফলে চিকিৎসা বন্ধ রাখতে হয়।
ডায়াবেটিস শব্দটি আমাদের সবার কাছেই বেশ পরিচিত। এমন একটি পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো ডায়াবেটিসের রোগী নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারী রোগ। এই রোগের অত্যধিক বিস্তারের কারণেই সম্প্রতি এমন ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দিন দিন বেড়েইে চলেছে এই সংখ্যা। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে প্রতি মাসে ১৪ শত কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, ষাটোর্ধ্ব ৮২ শতাংশ নাগরিকই হতাশায় ভোগেন। হতাশা বলতে বয়স্ক ব্যক্তিরা তাঁদের মানসিক হতাশার কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, চলতে-ফিরতে সমস্যা; আবার কেউ বলেছেন জীবন নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। যাঁদের বয়স ষাটের ওপরে, তাঁদের ৯৩ শতাংশই অসুস্থতায় ভোগেন। বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্থান শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস সমিতির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনটিকে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস হিসাবে পালন করছে এই খাতের স্বাস্থ্য কর্মীরা। ১৯৫৬ সালের ২৮ শে ফেব্রæয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সমিতি। বর্তমানে এই সমিতির হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় নিবন্ধিত রয়েছেন ৪৫ লাখের বেশি ডায়াবেটিস কর্মী। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ২০৪৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে দেঁড় কোটিতে।
অ ল ভেদে মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কিছুটা চরিত্রগত ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রধানত টাইপ-২ ও অন্যান্য বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় প্রথমবার ডায়াবেটিস ধরা পড়ার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব দেশে। উন্নত দেশে নারীদের বেশি সংখ্যায় টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগতে দেখা যায়, আর উন্নয়নশীল দেশে পুরুষেরা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে বেশি সংখ্যায় ভোগেন।
এই বিপুলসংখ্যক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ও আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে ডায়াবেটিসের হাত থেকে রক্ষা করতে এখনই আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বাকি জীবন ডায়াবেটিস নিয়েই কাটাতে হবে এবং প্রহর গুনতে হবে যে কখন ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত জটিলতাগুলো দেখা দেয়। তাই সব স্তরের মানুষকে জেনে-বুঝে সচেতনভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কর্মযজ্ঞে নিজের সামর্থ্য অনুসারে অংশগ্রহণ করতে হবে। একইসাথে সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসা সহজলভ্যতার দিকটি নজরে আনতে হবে।
লেখক: ডা. শামীম তালুকদার, জনস্বাস্থ্য গবেষক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস্ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, মেইল: shamim@eminence-bd.org
সহযোগিতায়: মো. জহুরুল ইসলাম, কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট অফিসার, এমিনেন্স এসোসিয়েটস্ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, মেইল: zahurul.islam@eminence-bd.org