Friday , October 11 2024
You are here: Home / ঢাকা ও ময়মনসিংহ / গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল-খড়ের ঘর রূপকথায় একদিন স্থান পাবে
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল-খড়ের ঘর রূপকথায় একদিন স্থান পাবে

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল-খড়ের ঘর রূপকথায় একদিন স্থান পাবে

মেহেদী হাসান, (নেত্রকোনা ):  এক সময় গ্রাম বাংলা মানেই মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনির ঘরের দৃশ্য চোখে পড়ত,কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ ঘরগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। এসব ঘর এখন আর বেশি একটা দেখা যায় না। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যেখানে নেত্রকোনা জেলার প্রতিটি গ্রামে চোখে পড়তো প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনির তৈরি ঘর। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরেও সেই মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের তৈরি ঘর তেমনটা আর চোখে পড়েনি। তাছাড়া এসব ঘর তৈরির কাজে নিয়োজিতদের অনেকেই ইতোমধ্যে তাদের পেশা পরিবর্তন করে নিয়েছেন।
বারহাট্টা উপজেলার দশাল গ্রামে এমন একজনকে পাওয়া গেল, যিনি এসব ঘর তৈরির কাজ করতেন, এখন পেশা বদলেছেন। মোতাহার আলী জানান, আগেকার দিনের মাটির তৈরি দেয়াল ও খড়ের ছাউনির তৈরি ঘরের জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে ইট, বালি, সিমেন্ট, লোহার রড, টিন ও কংক্রিটের ব্লকের তৈরি বড় বড় বিল্ডিং-অট্টালিকা। বিল্ডিং তৈরিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় তারাও কর্ম হারিয়েছেন। ফলে মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনির ঘর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনিও পেশা পরিবর্তন করে টিনের ছাউনির কাজ বেছে নিয়েছেন।
একই কথা জানিয়েছেন আজিজুল হক ও বাবু। তাছাড়া অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ইজিবাইক বা পাখি ভ্যান চালকের পেশা বেছে নিয়েছেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধ ফয়েজ উদ্দিন জানান, ৩০-৩৫ আগে তার বাড়িটি ছিল মাটির দেওয়াল বিশিষ্ট চার চালা খড়ের ছাউনির ঘর। শুধু তাই নয় পাশে মাওলা বক্সের ছিল আটচালা খড়ের ছাউনির ঘর। বাড়ির সামনে ছিল বড়োসড়ো একটি বৈঠকখানা।
সেখানে স্থানীয় বিরোধ সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করা হতো। মাটির দেয়াল বিশিষ্ট ঘরের খড়ের ছাউনি থাকার ফলে গরমের সময় ঠান্ডা ও ঠান্ডার সময় গরম অনুভূত হত। ওই জায়গাটি দখল করেছে এসি। সেই সময় ঘরের চালের ছাউনির উপর নির্ভর করেও অনেকের ব্যক্তিত্ব পরিমাপ করা হতো। অথচ ইট, বালি, লোহার রড ও সিমেন্ট, ও বর্তমানে অত্যাধুনিক কংক্রিট ব্লকের ভিড়ে মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনির ঘর তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে।
জেলার কলমাকান্দা উপজেলার পাঁচ গাঁও গ্রামের তোফাজ্জেল হোসেনের (৪৪) বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলে মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনির একটি ঘর। জানান, তিনি পেশায় একজন দিনমজুর। সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে বাড়তি অর্থ গচ্ছিত সম্ভব হয়নি। ফলে আধুনিকতার ছোঁয়া তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। গ্রামের অন্য সকলে বাড়ি ঘরের চেহারা পরিবর্তন করলেও অর্থের অভাবে তিনি রয়ে গেছেন সেই পুরনো ঐতিহ্যে। তোফাজ্জেল বলেন, প্রতি ১-২ বছরে একবার খড় পরিবর্তন করতে হয়। এ ধরনের খড়ের ছাউনি কাজে নিয়োজিত অনেকেই পেশা পরিবর্তন করার ফলে খড়ের ছাউনি করাতেও অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, পূর্বেকার সময়ে গ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের বাড়িতে বাড়িতে প্রতিটি সুন্দর ছাউনির পরিপাটি ছনের চালার ঘর। মাটির দেয়াল কিংবা বাঁশের বেড়ার ও ঘরের ছাউনির জন্য একমাত্র অবলম্বন ছিলো ছন। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ছন সংগ্রহ করে শ্রমিক লাগিয়ে ঘরের ছাউনি দেয়া হতো। এগুলো ছিলো গ্রামীন ঐতিহ্য।
কেউ কেউ ছন কেটে শুকিয়ে ভার বেঁধে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠতো ছনখলা। সেখানে ছনের অভয়ারন্যের পাশাপাশি দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থলও গড়ে উঠতো। দরিদ্র পরিবার সদস্যরা ছন সংগ্রহ করতে না পারায় ধান গাছের খড় সংগ্রহ করে ছাউনির কাজ সেরে নিতেন। এভাবেই দীর্ঘ সময়ে গ্রামীণ বাড়ির অধিকাংশ ঘরে ছনের ছালা শোভা পেত। ঘরের ছনের চালার মধ্যে চড়ুই পাখিও বাসা বাঁধতো। স্থানীয়দের মতে ছনের চালার ঘর ছিল খুবই স্বাস্থ্য সম্মত। তবে সময়ের পরিক্রমায় ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন ছনের চালার ঘরগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে।
সমাজকর্মী সীতারান বীন বলেন, ছনের ঘর গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডা ও শীতকালে গরম থাকে। তাই ছনের চালার ঘরে বসবাস ছিল স্বাস্থসম্মত। বর্তমানে গ্রামগঞ্জে ছনের ঘর তেমন চোখে পড়ে না। ইট-রড, বালু, সিমেন্ট ও টিন গিলে খেয়েছে ছনের ঘর। তবে বিত্তবান ও শৌখিন কেউ কেউ এখনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কিংবা ফ্যাশন হিসাবে নিজেদের বাড়ির কোন কোন ঘরের উপরে ছনের চালা দেয়ার চেষ্টা করেন। আগের তুলনায় মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন যাত্রার মানেরও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
আর তাই হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালিদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনি ঘরের চিহ্নটি। হয়ত সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, খড়ের ছাউনির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজম্ম রূপকথার গল্পে এই ঘরকে স্থান দিতে স্বাছন্দবোধ করবে

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!