সাধারভাবে আমরা যেটা জেনেছি, মানব জাতির উন্নতি ঘটে চারটি বস্তুর সমন্বয়ে যা হলো: ১. শিক্ষা কর্মদক্ষতা, ২. কর্ম অনুযায়ী সম্পাদন, ৩. কর্মক্ষমতা সৃষ্টি এবং ৪. ইতিবাচক কর্মস্পৃহা।
আমরা জানি উপরোক্ত বিষয়বলী আমাদের ভেতর তখনই বাস্তবায়ন হবে যখন আমাদের শিক্ষা, নৈতিকতা, সাস্থ্য এবং কর্মপ্রেরণার বিকাশ ঘটবে। বলা যায়, এই চারটি বিষয় যার ভেতরে আছে সে প্রাকৃতিক সম্পদের অশুভ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকে। সুতরাং মানব সম্পদ দক্ষতার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ কিংবা এর যথাযথ ব্যবহার অসম্ভব নয়।
এবার আসি মানব সম্পদ উন্নয়ন বলতে আমরা যা জেনেছি; মানব সম্পদ উন্নয়ন হচ্ছে প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপায়ের মাধ্যমে মানুষে মানুষের উন্নয়ন। অর্থাৎ মানব সম্পদ উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য তার মৌলিক চাহিদারসমূহ পূরণের পাশাপাশি তার সহজাত ও সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। এই দৃষ্টিতে মানবসম্পদ বলতে একটি দেশের সমস্ত জনসংখ্যাকে বোঝায়, শুধু যোগ্য ও প্রশিক্ষিত জনশক্তিকে বোঝায় না, বরং অদক্ষ শ্রমিকদেরও বোঝায়। অর্থাৎ, যারা উৎপাদন খাতে অবদান রাখে তাদের সকলকেই মানব সম্পদ বলে। আর মানব সম্পদ উন্নয়নের উদ্দেশ্যই হল এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে সকলেই তাদের যোগ্যতার প্রসার ঘটাতে পারে এবং প্রজন্মসমূহের জন্য সুযোগের সম্প্রসারণ ঘটাতে পারে। যেহেতু আমাদের প্রত্যেকের জীবনে সুযোগ সুবিধা লাভের জন্মগত অধিকার আছে আর তা লাভের সার্বজনীন স্বীকৃতি হল মানব সম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি।
আমরা জানি, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কার্ল মার্কস মানুষকে মানবীয় মূলধন হিসেবে বিবেচনা করেছেন। যাকে আধুনিক পরিভাষায় মানবসম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার আমরা এটাও জেনেছি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মানব সম্পদ উন্নয়ন বলতে ব্যক্তিকে কর্মে নিযুক্ত করার সম্ভবনা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বিবেচনা করেছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের মতে মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো কোন রাষ্ট্রের মানুষের সামগ্রিক বিকাশ প্রক্রিয়ার একটি অংশ, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সমগ্র জনসংখ্যার কর্মে নিযুক্তির সম্ভাবনা বাড়ানো যায় এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসাম্য দূর করা যায়। ফ্রেডারিক হার্বিসন ও চার্লস এ মায়ার্স এর মতে, মানব সম্পদ উন্নয়ন বলতে এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে কোনো সমাজের সকল মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতেই শেষ নয়; এফ. এইচ. হারবিসন এর মতেও, মূলধন, আয় এবং ভৌত সম্পদের কোনটাই একটা জাতির সম্পদ নয়। শুধু মানব সম্পদই একটি জাতির আসল সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। সুতরাং নিঃসংকোচে বলা যায় আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ মানব সম্পদের বিকল্প নেই।
প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণভাবে জণগণের যে রাষ্ট্র, সেটার মূখ্য চালিকাশক্তি ডিজিটাল প্রযুক্তি। এই জন্যই বর্তমান পরিস্থিতির পেক্ষাপটে বলা হচ্ছে আমাদের দেশ বিশ্বায়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাইতো মানুষ এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর। আর এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই হচ্ছে স্তরে স্তরে অনুন্নত জীবন ধারা বদলে দিয়ে জ্ঞানভিত্তিতে রুপান্তর করা। যেহেতু ডিজিটাল প্রযুক্তি বিদ্যার প্রসার ঘটেছে। এজন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের দেশ যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের পরিচয়ও রেখেছে। দেশে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। এজন্যই যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ডিজিটাল আমরাও স্বপ্ন দেখছি ডিজিটাল যার ফল আজকের ভয়াবহ অবস্থা। আসলে প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা কিছু কিছু সাফল্যের শীর্ষে গেলেও প্রকৃতির অশুভ ব্যবহারে প্রভাব পড়ছে আমাদের জনজীবনে দীর্ঘবিস্তারী আতঙ্ক। এটা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছে যা আমাদের দেশ বা জাতির জন্য আতঙ্কের। এ কথা চরম সত্য যে, প্রকৃতির সম্পদ অফুরন্ত নয়। এর যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদেরকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া আমরা সকলেই জানি এই সম্পদ দেশের সমস্ত কল্যাণকর কাজে ব্যবহার কিংবা আহরণ করা হয়। তাইতো দেখছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মাধ্যমে জলে-স্থলে এমনকি মহাশূন্যে পযন্ত অধিপত্য বিস্তারে হয়েছে। এর ফলেই ক্ষুদ্র-বৃহৎ কারখানা ও নগরের মতো আরও বহু সভ্যতার বিস্তারও হয়েছে। এবং এই সম্পদের উপর নির্ভর করেই দেশের জাতীয় সমৃদ্ধি হচ্ছে। এছাড়াও আমরা ভালো করেই জানি প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা সৃষ্টি করতে পারি না, কিন্তু না পারলেও এর আহরণ এবং ব্যবহার করতে পারি। এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক এই প্রকৃতিক সম্পদের আমরা উন্নয়নের নামে যথার্থ ব্যবহার করছি কিনা?
আমরা জানি, অফুরন্ত প্রকৃতির দানে সমৃদ্ধ অরণ্যের পটভূমিতে আমাদের গ্রামীণ সভ্যতা আজ আধুনিক সভ্যতার কর্মনাশা স্রোতে অরণ্যক পরিবেশ শান্ত সমাহিত জীবনের আর্দশ উন্নয়নে অনেকাংশেই ধ্বংস হচ্ছে।প্রকৃত ব্যবস্থা না থাকায় লোপ পেয়েছে বহু বনভূমি এর গহিন অরণ্য। প্রশ্ন হলো প্রযুক্তিবিদ্যার তো প্রসার ঘটছে। অস্বীকার করার উপায় নেই অনেক ক্ষেত্রে বহু উন্নয়নও হয়েছে, কিন্তু কৃত্রিম জীবনে আসলেই কি আমাদের মনের শান্তি বেড়েছে? নাকি কেড়ে নিয়েছে সাথে অনেক কিছুই?
বলা হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেষ্ট ব্যবহারের ফলে আমাদের এ বিজয় আমাদেরকে ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি হয়ে একটু একটু করে পরাজয়ের মধ্যও ফেলে দিচ্ছে, সেটা কি আমরা ভাবছি? কিংবা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রকৃতিক সম্পদের অমানবিক ব্যবহারে আমরা কি সমর্থ হবো সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে? ভাবছি না তো, তাইতো আজ আমারা এত এত ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি। মোট কথা প্রকৃতি ব্যবহার করতে করতে আমরা ভুলেই গেছি প্রকৃতির অশুভ ব্যবহারের কথা। ভেবে দেখেছেন, ওয়েব তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট আয়তন ১,৪৭,৫৭০বর্গ কিমি, যার ৯,৭৩৪বর্গ কিমি অভ্যন্তরীণ জলাশয়, বাড়িঘর দ্বারা পূর্ণ ১১,২২৭বর্গ কিমি, নগর কাঠামো ৯৫০বর্গ কিমি, তাছাড়া ২,১৫৪বর্গ কিমি বনভূমি। অথচ আমাদের ভোগ্য পণ্যের চাহিদা এমন পর্যায় দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের আকাক্সক্ষাগুলো অপরিমিত হওয়ায় অতৃপ্ত কামনা নিয়ে প্রকৃতির সকল সম্পদ অরণ্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ, জলসম্পদ ও সূর্যালোক সম্পদ ব্যবহার করেই আমরা সভ্যতার ইমারত তৈরি করছি। নির্বিচারে গাছপালা কেটে মুহূর্তেই বন উজাড় করে দিচ্ছি। নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নির্দয়ভাবে জলজ প্রণী হত্যাসহ বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্টগণ ও পরিবেশবিদগণ অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমিতির মধ্য দিয়ে বলেই যাচ্ছে, প্রকৃতির সাথে এমন অমানবিক নির্যাতনের দরুণ একদিন সব নিঃশেষ হয়ে যাবে। এতে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাবে। আমরা বঞ্চিত হবো বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকেও। এজন্যই প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে দূষণ আজ আমাদের অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। ফলাফল আজকের মহাসংকটের নিদারুণ চিত্র। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ নানাবিধ প্রকৃতিক সম্পদের ভয়ানক পৌছানো কথা। অথচ আমরা সকল কিছু জানার পরেও একবারও ভাবছি না যে যথেচ্ছ প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের পরিণতি কি? ভেবে দেখুন আজ দেশ কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে? শুধু কি তাই! জেনে বুঝে দিনের পর দিন নেশার অবসান না ঘটিয়ে বিবেকহীনভাবে প্রকৃতির ওপর নির্যাতন করে আমরা লাগাতরভাবে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে করে কাজ করে যাচ্ছি। অথচ করলেই দক্ষ মানব সম্পদের সহায়তায় আমরা ভালো কিছু চিন্তা করে নিজদের জীবনের লক্ষ্য তো নিদিষ্ট করতে পারি। কিন্তু সেই লক্ষ্যকে বাস্তবে রুপায়িত করার জন্য অবশ্যই কিছু ভূমিকার আবশ্যকতা রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা না বদলাচ্ছি আমাদের পরিবার বদলাবে না। আর তখন দেশকে বদলানো কথা তো প্রশ্নই আসে না। আমরা যখন শক্তিশালী অনুভূতির সাথে নিজের জীবন দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে সক্ষম হবো, তখন বিপরীত পরিস্থিতিও আমাদের আত্মবিশ্বাসকে হারাতে পারবে না। তখন আমরা যদি নিজেদের জোরে স্বাভিমানের সাথে, মাথা তুলে আমাদের দেশে বেঁচে থাকতে চাই, অবশ্যই তা পারব ইনশাআল্লাহ।
জীবনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আমাদের নিজেকে নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। কারণ জীবন প্রত্যেক মুহূর্তে বদলায় হতে পারে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আগামী দিনে আমরা আমাদের দেশে বর্তমান অবস্থা থেকে কিছুটা আলাদা দেখতে পাবো। এইজন্যই আমাদেরকে নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টাতে নিমগ্ন হতে হবে তাই আসুন প্রাকৃতিক সম্পদের অশুভ ব্যবহার বন্ধ করি। আজ থেকে এই সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের জন্য, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের আমাদেরকেই লড়তে হবে, নিজেদের স্থান নিজেদেরকে তৈরি করতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা নিজেদের ব্যাপারে ধারণা পোষণ করব। তাই আজ থেকে দক্ষ মানব সম্পদ প্রাপ্ত করার জন্য আমাদের নিজেদেরকে সম্পূর্ণ শক্তির প্রয়োগ করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষে কাজ করলেই আমাদের কাঙ্খিত উন্নতি হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক