এস এস সি’র ফল দিয়েছে। আমার বন্ধু অশেষ রায়ের ছেলে অর্ক খুব ভালো ফল করেছে। কিন্তু সামান্য ক’টি নম্বরের জন্য সোনার জিলাপি পায়নি। আমার বন্ধু এসব ফলাফল নিয়ে এতো সিরিয়াস নয়। সে জীবনকে কেঁদে ভাসিয়ে দেবার চেয়ে হেসে উড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতী। তবে অর্কের ফলাফলের আধেক কৃতিত্ব ওর মায়ের। এমন অল রাউন্ডার মা না হলে কোন ছেলে মেয়েই ভালো ফল করতে পারেনা।
অর্ক খানিকটা পারফেকশনিস্ট। সোনার জিলাপি না পেয়ে সে খুশি নয়। তাকে একটি খোলা চিঠি লিখি। যেহেতু আমার অনেক বন্ধুর ছেলে-মেয়েরই আজ ফল প্রকাশ পেয়েছে।
প্রিয় অর্ক,
জীবনে পারফেকশনিস্ট হওয়া কতকটা ঠিক কতকটা ঠিক নয়। কারণ আজ তোমার পারফেক্ট রেজাল্ট না পেয়ে মন খারাপ; এস এসসিতে পারফেক্ট রেজাল্ট পেয়ে আমার মন খারাপ হয়েছিলো। কারণ আমি নিজে ফার্স্ট বয় হলেও আমার বন্ধুরা ছিলো লাস্ট বেঞ্চি। ওদের রেজাল্ট বেশ খারাপ হওয়ায়; আমি আমার নিজের ফলাফল নিয়ে কোন আনন্দ করিনি। বাঁচতে তো হয় সমাজে। আমার বন্ধু সমাজের মন খারাপ হলে; আমি তো আত্মকেন্দ্রিক আনন্দে মগ্ন হতে পারিনা। জানো অর্ক, আমার স্কুলের লাস্ট বেঞ্চিরাই জীবনে সফল হয়েছে। কারণ ওরা ক্লাসরুমে ছিলো না; পথে ছিলো। আর এই পথটাই হচ্ছে বাংলাদেশ। এই পথে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নামের পরশ পাথর থাকে। যারা পরশ পাথরে ঘষে লাস্ট বয়কে মন্ত্রী বানায় কিংবা বিসিএস ক্যাডার বানায়।
আমার বন্ধুরা যাদের সিঙ্গাড়ার বিল দেবার পয়সা ছিলো না পকেটে; তারা এখন ফাইভ স্টারে ছাড়া খায়ই না। আর আমাদের যে বোকা বন্ধুরা হরলাল রায়ের “শ্রমের মর্যাদা” পড়ে রবার্ট ব্রুসের মতো সৎ ভাবে বিভিন্ন পেশায় পরিশ্রম করছে, তারা নিয়মিত স্ত্রীর কাছে সার্টিফিকেট পায়, যেখানে গোল্ডেন ডাক। মানে, “তোমাকে দিয়ে কিছু হলোনা। তোমার ক্লাসের লাড্ডু মারা ছাত্র এখন দিল্লির লাড্ডু খাচ্ছে; আর তোমার ব্যাংক একাউন্টে লাড্ডু।”
আমাদের ক্লাসের লিটেরেলি লাড্ডু মারা ছাত্রটি আওয়ামী লীগের চেরাগ ঘষে বিলিওনিয়ার হয়েছে। ওর বাড়ির দরজা বানাতে যে খরচ হয়েছে; তা দিয়ে বোকা লোকেরা পুরো বাড়ি বানায়। তুমি জন্মেছো বাবা রুপের রাণী চোরের রাজার দেশে। মানসিক প্রস্তুতি রেখো; তোমার ক্লাসের দুর্বল ছাত্র ইউনিভার্সিটির শিক্ষকের বাজারের ব্যাগ টেনে; পার্টির দেলোয়ার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হবে; ভিসি হবে!
ঐ যে পাড়ার মোড়ের যে ছেলেগুলো ইভটিজিং করে; এরা বড় হলে লোকজনকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ শেখাবে। এদের শীর্ণ শরীর গোয়েন্দা হাজির বিরিয়ানি খেয়ে চর্বি বহুল পৃথুল হলে; এরা তিতাস গ্যাস কিংবা ওয়াসার ডিরেক্টর হবে। লাল পাঞ্জাবি পরে ঘুরবে; আর ফেসবুকে প্রতিপক্ষের মায়ের বয়েসী নারীকে ইভটিজিং করবে! তোমাদের ক্লাসের যে ছেলেটা টেনে কষে পাশ করলো; সে মন্ত্রী হবেই। তুমি যদি বিসিএস দিয়ে সচিব হও বুড়ো বয়সে; তখন ঐ খারাপ ছাত্রকে স্যার বলতে হবে। সে তখন প্রতিশোধ নেবে শৈশবের খারাপ ছাত্রত্বের শ্লাঘার। এই দেশটা খারাপ ছাত্রদের প্রতিহিংসার কুরুক্ষেত্র।
তুমি সৎ জীবন যাপন করে যখন স্কুটারে করে রাস্তায় যাবে; তখন তোমার ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চি বিশাল প্রাডোর মোটা চাকার আঘাতে বৃষ্টির জল কাদা তোমার দিকে ছুড়ে দিয়ে “জয় বাংলা” কিংবা “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” বলে এগিয়ে যাবে। এখন যে সব লোক “ওয়েস্টিনের মন্দ আসরে” যায় বলে সুখ্যাতি আছে; এদের ছেলে মেয়েরাই লুট করে বানানো টাকার জোরে বিদেশের কোন একটা ইউনিভারসিটি থেকে কিছু একটা পড়ে এসে ঢাকা শহরে বড় বড় চেয়ারে বসে পাবলিকের ওপর চিফ হিট অফিসার হবে। দ্যাটস দ্য ওয়ে অফ দ্য থাগস অফ বেঙ্গল। এরা ধর্ম আর দেশপ্রেমের কথা মুখে বলে লুন্ঠন করে বাংলাদেশ। তাই তো দেখো; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গ্রাউন্ড জিরোতে মিশে যাওয়া জার্মানি মাত্র ২০ বছরে কল্যাণ রাষ্ট্র হয়েছে। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিতসা শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে জনগণের। সভ্য ঐ জনপদে বাক স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মুক্ত মিডিয়া, জনগণের ভোট দেবার অধিকার সব আছে।
আর বাংলাদেশে দেখো; বায়ান্ন বছর ধরে দুটি ডাকাত দল রাজনৈতিক দলের তকমা নিয়ে খুন লুন্ঠন শোষণ নিপীড়ন চালাচ্ছে। জনগণকে ন্যুনতম নাগরিক অধিকার দেয়নি। লাল সালু উপন্যাসের মজিদের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসে পীর ও খাদেম প্রথায় জনগণকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বৃটিশ ও পাকিস্তান উপনিবেশ গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উপনিবেশ এসেছে। এদেশ কার্যত স্বাধীন নয়। স্বাধীন দেশে সরকারি দপ্তরে সেবা নিতে গিয়ে কাউকে ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়না। ঘুষ দিতে হয় না। স্বাধীন দেশের পুলিশ জনগণকে নির্যাতন করেনা। স্বাধীন দেশের এলিট ফোর্স গুম বা ক্রসফায়ার করেনা। স্বাধীন দেশে রাজাকার থাকে না; শান্তি কমিটির মেম্বর থাকে না। এই দেশ পরাধীন বলেই এখানে সমাজে কেউ মন খুলে কথা বলে না। কারণ শান্তি কমিটির গুপ্তচরেরা ঘুরছে; তালিকা করে খুনে রাজবদরদের হাতে দেবার জন্য। এই দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শুরু হয়েছিলো; আজ পর্যন্ত তা চলছে। এই দেশ থেকে সেরা মেধা উচ্ছেদ করে লিলিপুটিয়ান আওয়ামী লীগ আর ব্লেফুসকুডিয়ান বিএনপির দুই ইঞ্চি চিন্তার মাপের সহমত ও রহমত বুদ্ধিজীবী তৈরি করা হয়েছে নৈরাজ্যের জাস্টিফিকেশান দেবার জন্য।
এই দেশে প্লট পদবী পদক শিল্প ঠিকাদারি দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের চিড়িয়াখানার বানরের মতো দলীয় খাঁচায় পুরে উন্নয়নের কলা খাওয়ানো যায়। তার মানে এই নয় যে, এই সমাজের পুরোটাই চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে। আমি কেবল ৮.৮৬ শতাংশ লোকের কথা বললাম; যারা দলান্ধ বা দলদাস। কিন্তু এর বাইরের বাংলাদেশ এক স্বপ্নের বদ্বীপ। অর্ক পৃথিবীর আর কোন দেশ আছে বলো; যে দেশের প্রতিটি মানুষের কন্ঠে সুর আছে; এতো মায়াময় মানুষ কোথায় আছে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের যে কোন অচেনা গ্রামীণ গৃহে গেলে ওরা তোমাকে আপ্যায়িত করবে; আত্মীয়ের মতো। হঠাত বাসে ট্রেনে দেখবে তোমার দাদুর বয়েসী একজন মানুষ তোমায় নাতির মতো স্নেহ করবে; সোনালী সময়ের গল্প শোনাবে। প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে দেখবে পলান সরকার বইওয়ালা হয়ে গ্রামের শিশুদের ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দিচ্ছেন। মহেশ্চরচান্দার স্বশিক্ষিত কৃষকের মতো মানুষেরা দেখবে সবুজ শস্য ক্ষেত্রের পাশে বসে; চারা-বীজ-ফসল বিজ্ঞানের গল্প শোনাচ্ছেন নবীন কৃষকদের। গার্মেন্টসের সেলাই দিদির বাসায় পাবে সততার অন্ন; স্বপ্নের মোমবাতির আলো। প্রবাসী শ্রমিক তার ক্ষুদ্র সামর্থ্যে স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-রাস্তাঘাট বানিয়ে বদলে দেয় তার মাতৃভূমি। একজন স্কুল শিক্ষক পলিটিক্যাল নেতাদের কাছে শত অপমান সহ্য করেও জনারণ্যে একজন জ্ঞান তাপস হয়ে ঘুরেন। এই দেশের সবচেয়ে সৎ যোগ্য মানুষেরা ঢাকার বাইরে বসবাস করেন। তারা আকাশে প্রত্যাশার আলো হয়ে জ্বলেন। দলীয় অমাবস্যায় পূর্ণিমার দ্যুতি ছড়ান দল নিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক রাজনীতি সচেতন গ্রামীণ এরিস্টোটলেরা। ভেবে দেখো এতো আগে যে দেশের তাঁতী মসলিনের মতো জাদুকরি মিহি বস্ত্র বুনতে পেরেছে; ইচ্ছা করলে তারা কেমন সব লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারেন। এখন তোমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে জ্ঞান লাভ করতে হবে। দুর্নীতিবাজ বাবার ছেলে স্পোর্টসকারে করে মনের গরীব মেয়েদের তুলে নিয়ে গেলে তুমি বরং লাইব্রেরিতে গিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে পড়ো; রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববীক্ষা গ্রহণ করো; নজরুলের সাহসকে অন্তরে ধারণ করো। সেই খরগোস আর কচ্ছপের গল্পটা মনে রেখো। ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ খরগোসেরা শেষ পর্যন্ত হেরে যায় জীবনের আনন্দময় রেসে। জিতে যায় ৯১ দশমিক ১৪ শতাংশ কচ্ছপ মানুষ। এটা লিখে রাখো আজ; খুলে পোড়ো তোমার পঞ্চাশ বছর বয়স পেরোলে। তুমি যদি সাম্য ভাবনাকে অন্তরে ধারণ করতে পারো; জীবন তোমাকে সমৃদ্ধি দেবে। হ্যাভস নটদের সাহায্য করলে কখনো সম্পদ ফুরায় না। এই কথাটা মনে রেখো। তুমি শুধু ঢাকা শহরের হুতু ও তুতসি দুটি ট্রাইবকে না চটিয়ে চুপচাপ জ্ঞান সাধনা করো। গ্রন্থ কীট না হয়ে জীবনকে দুচোখ ভরে দেখো; সিলেবাস মুখস্থ না করে ডানা মেলো জ্ঞান চরাচরে; আর প্রতিমুহূর্তে আনন্দে বাঁচো। তোমার বাবার মতো জীবনকে হেসে উড়িয়ে দাও; অন্য বোরিং লোকদের মতো একে কেঁদে ভাসিয়ে না দিয়ে। আনন্দম।
লেখক : সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক