যেখানে জামিনে বিদেশে চিকিৎসায় যেতে পারেন হাজি সেলিম অথবা সম্রাট; যেখানে শেখ হাসিনা চোখের ও কানের চিকিৎসা করতে বিদেশে যান; সেখানে খালেদা জিয়াকে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে কোন বাধা থাকার কথা নয়।
এই বাধাটা মনস্তাত্বিক। একজন নারী যাকে জেনেরেলি সবাই সুন্দরী বলেন; তার প্রতি একটি ‘বিউটি কমপ্লেক্স’; ইডিপাস কমপ্লেক্স বা ইলেকট্রা কমপ্লেক্সের মতোই একটি প্রাচীন কমপ্লেক্স।
পশ্চিমা সমাজ বেশ কিছুটা এভলভ করে যাওয়ায়; এই কমপ্লেক্স সে সমাজে হয়তো আজ আর প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু আমাদের যে অনগ্রসর মধুমতী সমাজ; আমাদের যে ফাঁপা ঠোঠা বাজার; যেইখানে বিশ্বের সবচেয়ে প্রকট রেসিজম আজো দৃশ্যমান; যেখানে হলুদ গায়ে মেখে, গ্লো ক্রিম মুখে মেখে, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স টুল দিয়ে কথিত সুন্দর হবার প্রতিযোগিতায় আমরা মগ্ন; সেইখানে সমাজের মানদণ্ডে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সমাজের তুলনামূলক আলোচনায় অনুজ্জ্বল মেয়েটি প্রতিনিয়ত যে বেদনার অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যায়; তাতে সুন্দরী মেয়েটিকে বিষ খাইয়ে কিংবা গলা টিপে মেরে ফেলার ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রচলিত লোককাহিনীগুলোতে প্রচলিত আছে। সমাজ এরকম খুনী তৈরি করে।
কালা-জাদুর প্রভাবে সরস ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক আমাদের সমাজে তাবিজ কবচ তুক তাক বাণ মেরে ‘সুন্দরী’ নারী বশীকরণ, তাকে অসুস্থ করে ফেলার ঘটনাগুলোর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না থাকলেও; এরকম অসংখ্য ঘটনার নজির আছে।
অনেকেই ভারতীয় সোপগুলোর ‘ঘর ঘর কী কাহানী’ দেখে বিরক্ত হন; বলেন কী এসব! কিন্তু এই সোপই কিন্তু আমাদের এই পশ্চাদপদ সমাজের আসলচিত্র। আমাদের নেতাদের যে কথামালা তা যেন বউ-শাশুড়ি ঝগড়ার সংলাপে তৈরি। রাজনীতির প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের গল্পগুলো কিন্তু আকাশ থেকে আসেনি। আমাদের ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক মধ্যযুগীয় জনগোষ্ঠীর যে সমাজ মনন; যার এক্সরে রিপোর্ট আপনি প্রতিদিন ফেসবুকে দেখেন; এইখানে একবিংশ শতকে যে আদিম আঙ্গিকে ধর্মীয় রিচুয়াল দেখি আমরা; একদল লোক সুদূর নিউইয়র্ক কিংবা টরেন্টোতে গিয়েও যেভাবে ওয়াজ-মেহেফিল ও পূজা-অর্চনা করে; এমন ট্রাইবাল চেহারা-পোশাক-গোত্রকেন্দ্রিক সংকীর্ণ চিন্তার ভার্চুয়াল রিপ্রেসেন্টেশন দেখে আমাদের সেলফ একচুয়ালাইজেশন হয়ে যাওয়া উচিত।
এই সমাজটিতে বন্ধুবৃত্ত তৈরি হয়; পরচর্চা করার এরিয়া কমননেস খুঁজে খুঁজে। একসঙ্গে বসে বসে অপরকে ম্লেচ্ছ-নেড়ে-জঙ্গী কিংবা মালাউন-চাড্ডি বলে গালি দেবার মাঝেই এ সমাজের ধর্ম চর্চার আনন্দটুকু যেন। কলতলায় জায়নামাজ পাতলে কিংবা আলপনা আঁকলেই তা সত্য ও সুন্দরের হয়ে যায়না। আরেকদল আছে দেখবেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ করে এলিট ইনগ্রুপ তৈরির নেশায় বুঁদ। কুঁজোরও চিত হয়ে শোবার চেষ্টা; এই গ্রামীণ প্রবচনটি নিষ্ঠুর; কিন্তু এই বাস্তবতা আছে বলেই ‘কুঁজোর’ ‘আর্য’ সাজার চেষ্টা ধর্মান্ধ ও দলান্ধ গোষ্ঠী গুলোর মাঝে দৃশ্যমান।
ঐ যে কে কবে ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর মনে ‘আর্য’ হবার স্বপ্ন গেথে দিয়েছে; তা থেকেই এই ‘যেমন খুশি এলিট সাজো’র কষ্ট কল্পনা। একই মানুষের মধ্যে সুন্দর-অসুন্দর, সাদা-কালো, আর্য-অনার্য বলে আমরা বনাম ওরা করে করে এই হিংস্র নরভোজি সমাজ রচিত হয়েছে।
খালেদার চিকিতসা বিদেশে না হতে দেবার পেছনে শক্ত পোক্ত কোন রাজনৈতিক কারণ নেই। খালেদা তাঁর আপন সৌন্দর্যে বৈরি। তিনি যদি সমাজের ঐ কথিত আর্য চিন্তার অতি প্রশংসায় সুন্দরী খ্যাতি না পেতেন; তাহলে তার চিকিৎসা হতো।
কোন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার; একজন অসুস্থ মানুষের চিকিতসা করাতে হবে; এটাকে যখন, বয়স তো আশি, সময় তো হলো, আর কত ইত্যাদি আলফাডাঙ্গার কথামালায় সাজানো হবে; তখন এর মধ্যে রাজনীতি-ইতিহাস-ক্ষমতার দ্বন্দ্ব; ইত্যাদি খোঁজা হচ্ছে ভ্রান্তির গোলকধাঁধায় ঘোরাঘুরি। আসল ব্যাপার হচ্ছে; ও কেন এতো সুন্দরী হলো!
আমাদের সমাজের লোক সৌন্দর্য নিয়ে আদিখ্যেতা করে করে; তুলনামূলক আলোচনায় ‘অমুক সুন্দর নয়, স্মার্ট নয়’ ইত্যাদি চিতলমারী টাইপের আলাপ করে করে মানুষকে অবচেতনে খুনী করে তোলে!
বয়স ও অভিজ্ঞতা মানুষকে ঋদ্ধ করে। কিন্তু জীবনের পোস্ট ট্রমাটিক ডিজ অর্ডার ও বাই পোলার ডিজ অর্ডারের রোগীরা; প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার নেশায় তেতো অনেক মানুষ পরিণত আচরণ শিখতে পারেন না।
মানুষ দুরকম। যে তার জীবনের তিক্ত স্মৃতিগুলোকে একপাশে রেখে আনন্দময় স্মৃতির চর্চা করে; সে বয়স অনুযায়ী পরিণত আচরণ করে। কারণ সে আনন্দে থাকে।
আর জীবনের সিলেবাস শুধু তিক্ত স্মৃতির নিয়ত চর্চা; শুক্রবার বিকেলে ভাড়া করা রুদালি নিয়ে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’; সে জীবন হচ্ছে তিক্ত স্মৃতির গোলকধাঁধার জীবন। আপনি তাকে চন্দ্র বিজয় করে এনে দিলেও সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে বলবে, আমার বাপে দেইখা যাইতে পারলো না।
পৃথিবীতে কার জীবনে ট্র্যাজেডি নেই বলুন। কিন্তু ট্র্যাজেডি আছে বলেই পৃথিবীর অন্য সব মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডির বিন্দুমাত্র সমানুভূতি না দেখিয়ে খালি আমি যদি আমার পরিবারের বিয়োগব্যথা নিয়ে কেন্দে জারে জার হই; তাহলে আমার চেয়ে স্বার্থপর মানুষ তো আর হয় না।
আমাদের ভাগ্যে নেই প্রগতি ও সভ্যতা; আমাদের ভাগ্যে নেই স্বাভাবিকতা। আমরা আসলে পদ্মা সেতুর ওপর ট্রেন চালিয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করে, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল করেও; মধুমতী নদীর পাঁক থেকে উঠতে পারলাম না। আমরা আমাদের মনের মধ্যে চর দখলের লড়াই এর গ্রাম, মাতবরের ভিলেজ পলিটিক্সের গ্রাম, ঈর্ষায় মাথা ফাটিয়ে দেয়ার গ্রাম, ঠগীদের রুমালের ফাঁস দেয়া গ্রামগুলোর তালগাছ রোপণ করেছি। এখন আপনারা দলান্ধ-ধর্মান্ধ-প্রতিহিংসা পরায়ণ লোকেদের মাথা দেখিয়ে বলতে পারেন; ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ, ঐখানেতে বাস করে কানাবগির ছা।
বার্ধক্যজনিত রোগ দুরকম হয়, শারীরিক অথবা মানসিক। খালেদা জিয়ার শারীরিক রোগ। এটা বরং একদিক দিয়ে ভালো। যেসব প্রবীণের মানসিক রোগ হয় তারা নবীনদের অনেক বিরক্ত করেন নানাভাবে।