Tuesday , December 10 2024
You are here: Home / মতামত / সেন্টমার্টিন ভ্রমণে পর্যটক নিয়ে শঙ্কা : মো. শহিদুল্লাহ্
সেন্টমার্টিন ভ্রমণে পর্যটক নিয়ে শঙ্কা : মো. শহিদুল্লাহ্

সেন্টমার্টিন ভ্রমণে পর্যটক নিয়ে শঙ্কা : মো. শহিদুল্লাহ্

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন নির্দেশিকা, ২০২৩ জারি করে বলেছে সকল পর্যটক কর্তৃক সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণের জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে৷ সেন্টমার্টিন দ্বীপে অবতরণের জন্য পর্যটকদের ফি প্রদান করতে হবে৷
সেন্টমার্টিন দ্বীপে দিন প্রতি প্রকৃত ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটকের সংখ্যা নিশ্চিত করতে হবে৷

সেন্টমার্টিন ভ্রমণে নতুন নিয়ম-কানুনে লাগবে রেজিস্ট্রেশন৷ এ বছর অক্টোবর মাস থেকে শুরু হতে যাচ্ছে পর্যটন মৌসুম। এই সময়ে পর্যটকবাহী জাহাজে আসা যাওয়ার মাধ্যমে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হয়। কিন্তু নতুন নিয়মে এখন থেকে চাইলেই পর্যটকরা নারকেল জিঞ্জিরা খ্যাত সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে যেতে পারবেন না। সেখানে যেতে হলে মানতে হবে বেধে দেওয়া ভ্রমণের অনেক নতুন নিয়ম-কানুন। একই সাথে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন বাধ্যবাধকতা ও মানতে হবে। তবে এ
বিষয়ে পর্যটনের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা বলছেন, হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে কক্সবাজার সহ
সেন্টমার্টিনের পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে৷

কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন এর সৌন্দর্য উপভোগে পর্যটন মৌসুমে ছুটে যান দেশ-বিদেশের হাজারো
ভ্রমণপিপাসু মানুষ। কিছু মানুষ মনে করেন এতে দ্বীপটি একটু একটু করে তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। এহেন
পরিস্থিতিতে দ্বীপকে রক্ষায় কাজ করতে চাইছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

তাদের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পর্যটকদের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যেতে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এ
ছাড়া এ দ্বীপে যেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফিসও ভরতে হবে। দ্বীপে প্রতিদিন বেধে দেওয়া ধারণক্ষমতানুযায়ী পর্যটক
আসা যাওয়া নিশ্চিত করবে কর্তৃপক্ষ।

হুট করে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে পর্যটন
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অভিমত জানিয়েছেন৷

সেন্ট মার্টিনের কিংশুক ইকো বিচ রিসোর্ট-এর স্বত্বাধিকারী জনাব সরোয়ার কামাল বলেছেন এই নির্দেশনা
পর্যটনবান্ধব হবে না৷
পর্যটনের ভারসাম্য ঠিক রেখে মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় পর্যটন ব্যবসা হচ্ছে৷
এ বিষয়ে আমাদের যে নীতিমালা দেওয়া হচ্ছে তা আমরা মেলে চলব এবং কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবে৷

আমরা শুধু ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা করছি না৷ এখানে শর্ত দেয়া হয়েছে যদি শর্ত লঙ্ঘন করা হয় তবে তা
লঙ্ঘনকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসলে আমাদের আপত্তি থাকবে না৷ পর্যটকদের সংখ্যা সিমীত বা
রেজিস্ট্রেশনের যেটাই করা হোক না কেন কেউ মানতে চাইবে না৷ পৃথিবীর কোথাও নজির নেই যে পর্যটক সীমিত
করা হয়৷ পর্যটকের সংখ্যা সীমিত করে পর্যটনের উন্নতি হয়েছে পৃথিবীতে এমন নজির নেই৷ এখানে ১৯০০
পরিবার বসবাস করে৷ এখানে ১২ হাজার অধিবাসী রোহিঙ্গাসহ৷ কিছু সংখ্যক লোক মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ
করে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের জীবন এবং জীবিকা নির্বাহ করে পর্যটন খাত থেকে৷ যে পাঁচ মাস
সেন্টমার্টিনে পর্যটক আসা-যাওয়া করে সেই পাঁচ মাসের আয় থেকে এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীর সাং
বছরের অন্ন সংস্থান হয়৷ এজন্য পর্যটক সংখ্যা সীমিত করা রাত্রী যাপনের অনুমতি না দেওয়া এবং রেজিস্ট্রেশন ও ফিস
প্রদানের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন আসার নিয়ম করলে পর্যটন ব্যবসায় ধ্বস নামবে৷ সেন্টমার্টিন এর অধিবাসী
মোঃ আব্দুল্লাহ বলেন এটাতো বিদেশ নয়, এটা আমাদের নিজের দেশ৷ অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করে নির্দিষ্ট ফিস দিয়ে
এদেশের মানুষ কেন সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করতে আসবে৷ এখানে যে টাকা খরচ হবে তার চেয়ে কিছু বেশি টাকা
দিয়ে তারা বিদেশ ভ্রমণ করবে৷ পর্যটক সংখ্যা যদি সীমিত করা হয় এবং যদি তাদের রাতে থাকতে না দেয়া হয় তাহলে
কোন পর্যটক হোটেল রিসোর্ট ভাড়া করবে না ফলে এখানে হোটেল এবং রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাবে৷
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ মোঃ এরশাদ বলেন মাসে তার বেতন ৬ হাজার ৫০০ টাকা৷ অর্ধেক দেয়
ইউনিয়ন পরিষদ অর্ধেক আসে ইউ এন ও অফিস থেকে তাও নিয়মিত পান না৷ সংসারে তার স্ত্রীসহ চার ছেলেমেয়ে
রয়েছে৷ তিনি পেট বাঁচানোর জন্য ঋণ করে একটা অটো রিক্সা কিনেছেন৷ পর্যটন মৌসুমে তিনি তার অটোতে
পর্যটক বহন করেন৷ তাতে যা আয় হয় সেসব টাকা জমিয়ে রেখে তিনি সারা বছর সংসার চালান৷ যদি অনলাইন
রেজিস্ট্রেশন এবং নির্দিষ্ট ফি দিয়ে সেন্টমার্টিন আসার জন্য নিয়ম করা হয় তবে সেন্ট মার্টিন এ পর্যটক
আসবেন না৷ ফলে পর্যটন ব্যবসায়ে ধ্বস নামবে৷ আমাদের রুটি রুজির ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে৷
এছাড়া রাতে যদি পর্যটক না থাকতে পারেন তাহলে এখানে পর্যটন ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বেন৷

সেন্টমার্টিনের কিংশুক ইকো রিসোর্টের ম্যানেজার সাখাওয়াত তালুকদার বলেন তিনি অনেকদিন যাবত এই
রিসোর্টে ম্যানেজার হিসেবে আছেন৷ পর্যটন সিজনের পাঁচ মাস এই রিসোর্ট চললে তার থেকে তার যা আয়
হয় তাই দিয়ে সারা বছর তিনি তার স্ত্রী সন্তানদের অন্নের সং¯হান করেন৷ নতুন নিয়ম চালু হলে যদি পর্যটক না
আসে তবে পর্যটন ব্যবসার ক্ষতির কারণে তিনি বেকার হয়ে যাবেন৷ ফলে তার স্ত্রী সন্তানদের চালাতে তাকে নতুন কাজ
খুঁজতে হবে, সে কাজ তিনি কতদিনে পাবেন জানেন না৷ তায় তিনি সামনে অন্ধকার দিনের শঙ্কায় আছেন৷

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছে
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে। একাজে তাদের সহযোগিতা করবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
এব্যাপারে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি বলে প্রশাসনের তরফ থেকে জানা গেছে মর্মে খবর বেরিয়েছে৷।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন
হয়েছে এটা জানতে পেরেছেন বলে সবাইকে অবহিত করেছেন। তিনি বলেছেন এই বিষয় নিয়ে এখনও কোনো
আলোচনা করা হচ্ছে না, যেহেতু আলোচনা করার সুযোগ এখনও আমাদের হয়নি। এই বিষয় নিয়ে আলোচনা পরে
হবে৷
ট্যুরিস্ট পুলিশের মত হলো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সবার সঙ্গে আলাপ করেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সেন্টমার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় এমন সিদ্ধান্ত বলে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে৷
জানা গেছে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিআইজি মো. আবু কালাম সিদ্দিক বলেছেন সেন্টমার্টিনের বিষয়ে সব স্তরের
পর্যটন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া সেন্টমার্টিনগামী সব জাহাজ মালিকদের সঙ্গেও
আলোচনা করা হবে। যেহেতু আগামী মাস থেকে জাহাজ চলাচল শুরু হবে। মূলত সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ট্যুরিস্ট পুলিশ৷

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মো. নুরুল আবছার বলেছেন, পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে গিয়ে
যেখানে-সেখানে ময়লা-আর্বজনা ফেলছে, পরিবেশ নষ্ট করছে, রাতের বেলা আলোকিত করে গান-বাজনা করছে। এতে
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন তার সৌন্দর্য হারাবে৷
তিনি আরও বলেছেন, ছোট্ট একটা উদাহরণ হলো, দ্বীপে যে কাছিম ডিম পাড়তে আসে, তারা যেখানে মানুষজনের
যাতায়াত কম, শব্দ বা আলো কম সেখানে বসবাস করে। সেন্টমার্টিনে পর্যটকের আগমন বেশি, গান-বাজনা,
দ্বীপে রাতের বেলা আলো জ্বালানোর কারণে কাছিম আর অবস্থান করছে না। ফলে সেন্টমার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত
সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। যার জন্য সরকারের এ উদ্যোগ। পর্যটকদের রেজিস্ট্রেশন করে সেন্টমার্টিনে যেতে
হবে। যাতে করে সীমিতসংখ্যক পর্যটক পর্যটন মৌসুমে সেন্টমার্টিনে যেতে পারে। এব্যাপারে এখনও কোনো
আলোচনা হয়নি বলে প্রশাসনের তরফ থেকে জানা গেছে মর্মে খবর বেরিয়েছে৷। এ বিষয়ে সেন্টমার্টিন পর্যটন
পুলিশের এসআই অভিজিৎ বলেন নতুন নিয়ম এখনো চালু হয় নাই তা প্রস্তাবনা আকারে রয়েছে৷ হয়তো ভবিষ্যতে
চালু হতে পারে৷ বর্তমানে টেকনাফ থেকে বার আউলিয়া নামে একটা শিপ ২৭ এ সেপ্টেম্বর থেকে সেন্টমার্টিন ও
টেকনাফের মধ্যে আসা যাওয়া করছে৷ তাতে করে ৭/৮শত-এর মতো পর্যটক আসা-যাওয়া করছেন৷ অন্য কোন শিপ এখনো
ছাড়ার অনুমতি পাই নাই ৷
নতুন নির্দেশনা কার্যকরী করা হলে পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে আসতে
নীরুৎসাহিত হয়ে পড়বে ফলে সেন্ট মার্টিনের পর্যটন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে মর্মে সেন্ট মার্টিনের পর্যটন
ব্যবসায়ীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ৷ নতুন নিয়মের প্রয়োগে সেন্টমার্টিনের পর্যটন ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে
পারে মর্মে পর্যটন ব্যবসায়ী ও সেন্ট মার্টিন-এর স্থানীয় জনসাধারণ যে শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এখন দেখার বিষয় নতুন
নিয়ম কার্যকরী হলে পর্যটন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কার প্রতিফলন বাস্তবে কতটুকু ঘটে৷

লেখক- সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, লেখক ও কলামিস্ট৷

 

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!