Saturday , May 18 2024
You are here: Home / অন্যান্য / বিভক্ত রক্তাক্ত লিবিয়া
বিভক্ত রক্তাক্ত লিবিয়া

বিভক্ত রক্তাক্ত লিবিয়া

এক সময় লিবিয়া আর গাদ্দাফি ছিল এক এবং অভিন্ন নাম। ২০১১ সালে গাদ্দাফির নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিরোধীরা মনে করেছিল সেখানে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে থাকবে। কিন্তু হয়েছে তার বিপরীত। তখন থেকে লিবিয়া বিভক্ত এবং রক্তাক্ত। এক নেতার পরিবর্তে হাজারো নেতার আবির্ভাব ঘটেছে গোত্রগতভাবে শতধাবিভক্ত তেলসমৃদ্ধ এই দেশে। শুধু বিশ্ব রাজনীতির দিকপালরাই নয়, পাতি নেতা, উপনেতারা লিবিয়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বহুমুখী লড়াইয়ে ব্যস্ত। এসব লড়াই বন্ধের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে শান্তি প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে সেই প্রথম থেকে। গাদ্দাফি সরকারের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক মোড়লেরা সেখানে ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড—জিএনএ’ তথা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে। সাধারণ দেশগুলো এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। সেখানে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক সরকার চালুর চেষ্টা করা হয়। গাদ্দাফি-উত্তর নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তি জয় লাভ করে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী সম্প্রসারণবাদী শক্তিগুলো গণতান্ত্রিক শক্তিকে সহযোগিতা দেওয়ার পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ গোত্রগত বিভেদকে তাদের প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার করে। মূলত লিবিয়ায় সঞ্চিত প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করার জন্যই তারা বিভক্তি ও রক্তারক্তিকে উত্সাহিত করে। বিগত ১০ বছর ধরে বহুমুখী সমীকরণের গৃহযুদ্ধ অবশেষে দুটো প্রধান বিভাজনে যুদ্ধ ও বিভক্তির সীমারেখায় অগ্রসর হয়। তার একটি হলো, জাতিসংঘ সমর্থিত ও পৃথিবীর সাধারণ রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জিএনএ সরকার। অপরটি হলো, সম্প্রসারণবাদী শক্তির সমর্থনপুষ্ট, এক দশক ধরে শক্তি সঞ্চয়কারী তবরুকভিত্তিক তথাকথিত জেনারেল হাফতারের তথাকথিত সরকার। লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি—এলএনএ সরকার নামে এটি সমধিক পরিচিত।

বিগত ১০ বছর ধরে জেনারেল হাফতার শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। গত বছরের এপ্রিল মাসে রাজধানী ত্রিপলির ত্রিসীমায় তারা পৌঁছে যায়। এতদিন যে যুদ্ধ ছিল আঞ্চলিক, তা এবার রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়ায়। সুবিধাবাদী ও শক্তির পূজারি রাষ্ট্রকর্তৃত্ব কতিপয় দেশ হাফতারের ক্রমবর্ধমান অগ্রসর অবস্থাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদত দিতে থাকে। অথচ তারাই জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি সম্মত সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের গণবিরোধী সরকারগুলো—মিশর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারের পাশে এসে দাঁড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত সরকারের বড়ো একজন সমর্থক হলেও নীতিবিবর্জিত শক্তি মদমত্ততায় আক্রান্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকারান্তরে জেনারেল হাফতারের পক্ষ নেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি বলেন, তিনি লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পালনের কোনো অবকাশ দেখছেন না। অভিযোগ রয়েছে, হাফতার ত্রিপোলিতে আক্রমণ শুরু করার পর ওয়াশিংটন ভোল পালটাতে থাকে। বার্তা সংস্থার খবরে আরো বলা হয় যে, গত ১৯ এপ্রিল ট্রাম্প হাফতারের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখানে তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং লিবিয়ার তেল সম্পদ রক্ষায় হাফতারের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। এদিকে রাশিয়ার ভূমিকাও দ্বৈধতামূলক। জিএনএ সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের সমর্থন অব্যাহত থাকলেও পরবর্তীকালে প্রকারান্তরে তারা হাফতার বাহিনীকে সহায়তা দেয়। রাশিয়া সরকারিভাবে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিচ্ছে না। তবে এলএনএ সরকারকে তারা সামরিক ঠিকাদারদের মাধ্যমে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। মূলত হাফতারের প্রতি অন্যান্য দেশের সহযোগিতার সঙ্গে রাশিয়ান সামরিক সহযোগিতা যুক্ত হওয়ার পর হাফতার বাহিনী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখন সরাসরি তুর্কি সামরিক সহায়তা গ্রহণের পর ত্রিপোলি সরকার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করল। সুদানে সৌদি-সমর্থিত সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও হাফতার বাহিনীকে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে। সুদান তাদের ‘রেপিড সাপোর্ট ফোর্স—আরএসএফ’ ১ হাজার সদস্যকে হাফতারের সমর্থনে মোতায়েন করেছে বলে জাতিসংঘের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়। লিবিয়ায় সুদানিজ সামরিক কমান্ডারদের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, হাফতারের সামরিক অভিযানে আরো ৩ হাজার সেনা অংশ নিচ্ছে। জর্দানও সেনা পাঠিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের উল্লিখিত প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে লিবিয়ার বিদ্রোহী বাহিনীকে সহায়তার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল জিএনএ সরকারে মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশগ্রহণকে দায়ী করছেন।

অপর দিকে লিবিয়ার আইনানুগ সরকারকে রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছেন তুরস্কের এরদোয়ান সরকার। সেখানে তারা জিএনএ সরকারের অনুরোধে সেনা পাঠিয়েছে। সম্প্রতি তুর্কি সংসদের অনুমোদনের পর আংকারা লিবিয়ায় সেনা মোতায়েন শুরু করেছে। এরদোয়ান সেনা পাঠানোর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘লড়াই করা নয় বরং বৈধ সরকারকে সমর্থন করা এবং একটি মানবিক ট্রাজেডি এড়ানো সেনা পাঠানোর লক্ষ্য’। উপসাগরীয় রাষ্ট্র, সৌদি জোটবিরোধী কাতারও লিবিয়ার জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। শক্তি প্রদর্শনে উভয় পক্ষ যখন সমানে সমান তখন যৌক্তিভাবেই সমঝোতা এবং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এসেছে। সম্ভবত তুরস্কের নতুন মিত্র রাশিয়ার চাপে জেনারেল হাফতার শান্তি প্রয়াসে সম্মতি দেন। সেখানে অস্থায়ী যুদ্ধ বিরতি করতে উভয় পক্ষ রাজি হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা খবর দিয়েছে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক জিএনএ সরকার প্রধান ফয়েজ আল সররাজ এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল খলিফা হাফতার যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মস্কো গিয়েছিলেন ১৩ জানুয়ারি ২০২০। উল্লেখ্য, এর আগের দিন ১২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েপ এরদোয়ান আংকারায় পারস্পরিক আলোচনা শেষে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জেনারেল হাফতার প্রাথমিকভাবে যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারে রাজি না হলেও অবশেষে দুই শক্তিধর দেশের আহ্বানে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করেন চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জেনারেল হাফতার বেঁকে বসেন। তিনি চুক্তি স্বাক্ষর না করেই লিবিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন।

এ রকম একটি অচলাবস্থা এবং সমাগত সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানোর জন্য জার্মানির উদ্যোগে ২০ জানুয়ারি বার্লিনে আয়োজন করা হয় ‘লিবিয়া সম্মেলন’। বিশ্বশান্তির কথা মাথায় রেখে বিশ্বের ১৬টি দেশ ও কয়েকটি সংস্থা এতে অংশ নেয়। সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েপ এরদোয়ান, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিইউসেপ্পকন্টি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস যোগদান করেন। এছাড়া চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মিশর ও আলজেরিয়া অংশ নেয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং আরব লিগের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করেন। কোনোভাবেই লিবিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোকে অস্ত্র এবং সামরিক সাহায্য দেওয়া হবে না। বার্লিন সম্মেলনে সমবেত নেতারা সংকট সমাধানে এমন একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাবে সম্মত হন। পরস্পর বিপরীত স্বার্থ ও সমীকরণে বিভক্ত নেতারা যে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, যে কোনো বিবেচনায় তা অনন্য। লিবিয়ার ক্ষমতাশালী জেনারেল খলিফা হাফতার ও জাতিসংঘ-সমর্থিত জিএনএ-এ উভয় পক্ষই সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও একে অপরের সঙ্গে কথা বলেননি। বার্লিন সম্মেলনের আগেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের শান্তি প্রয়াস গৃহীত হয়। কিন্তু সফলতা অর্জিত হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়, লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ থেকে মুনাফা লুটের চেষ্টা করে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। এ অভিযোগের কাতারে রয়েছে ফ্রান্স, ইতালি ও রাশিয়া। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত ঐসব সামরিক সাহায্যের কারণেই গৃহযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়। অস্ত্র বিক্রির ধান্ধায় এসব দেশ বিবদমান পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ জিইয়ে রাখে। বার্লিনে লিবিয়ার সম্মেলনে এই বিষয়টিকে সামনে রেখেই দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে নেতারা একমত হন, এসব দেশগুলোকে তারা আর অস্ত্র এবং সামরিক সাহায্য দেবেন না। জামার্নির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল সমাপনী প্রস্তাবনা পাঠ করেন। এতে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়, কোনোভাবেই যাতে অস্ত্র দিয়ে ঐসব দেশকে সাহায্য করা না হয়, তার দিকে সবাই কড়া নজর রাখবে। শক্ত শক্ত শব্দাবলির এই উচ্চারণ আন্তর্জাতিক মহলে শক্ত আস্থার সৃষ্টি করতে পারেনি। এর আগেও অস্ত্র ভারসাম্যনীতি কিংবা অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে বহুবার বিভিন্ন সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ একাধিকবার এসব বিষয়ে প্রস্তাব পাশ করেছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন সব সময় ঘটেনি। কারণ, অস্ত্র একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালে বিশ্ব জুড়ে অস্ত্রের বাজার আরো বড়ো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বার্লিনে ‘লিবিয়া সম্মেলন’ কতটা শান্তির পথে অবদান রাখতে পারবে তা একটি বিবেচ্য বিষয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ উভয় সংস্থাই লিবিয়ার সম্মেলন ফলোপ্রসূ হয়েছ বলে মনে করেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলিকে স্বাগত জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্মেলনে অংশ নিলে সিদ্ধান্তের প্রতি আরো আস্থা প্রকাশ পেত। লিবিয়ার বিষয়ে দুই ঘনিষ্ঠ শক্তি—রাশিয়া ও তুরস্ক সম্মেলনের সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটে নিপতিত বিশ্বে বার্লিন সম্মেলনের ফলাফল অনুধাবনে আরো কিছু সময় লাগবে। ‘পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ দেশগুলোর বাস্তব কার্যক্রম যদি সত্যিই সমঝোতার পক্ষে হয়, তাহলে অচিরেই লিবিয়ায় শান্তির সুবাতাস বইবে।

লেখক: ড. আবদুল লতিফ মাসুম

অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

About দৈনিক সময়ের কাগজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top
error: Content is protected !!